ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় পবিত্র রমজানেও থেমে নেই ইসরায়েলি হামলা। বিভীষিকাময় অবস্থা বিরাজ করছে পুরো গাজাজুড়ে। সোমবার রমজানের প্রথম দিন উদ্যাপন করেছে ফিলিস্তিনিরা। খাবার সংকটের পাশাপাশি তাদের নিত্যসঙ্গী রোগ-শোক। প্রতিদিন ইসরায়েলি হামলায় মারা যাচ্ছে শত শত মানুষ।
নানা আয়োজনে সংযমের মাস রমজানকে স্বাগত জানিয়েছে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের মুসলমানরা। তবে গাজাবাসী সেই অবকাশ পায়নি। ইসরায়েলি বোমায় ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন ভবনের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বেঁচে যাওয়া মানুষ কিংবা লাশের সন্ধানে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে তাদের।
রোজার সময়ে গাজাজুড়ে আরও বেশি অভাব অনুভব করছেন বাসিন্দারা। জাকি আবু মনসুর (৬৩) নামের এক ফিলিস্তিনি বলেন, ‘আমরা জানি না, রোজা ভাঙার জন্য কী খাব। আমার কাছে কেবল একটি টমেটো ও শসা আছে। কিছু কেনার টাকাও নেই।’
গাজার দক্ষিণ সীমান্তে রাফাহ শহরে আশ্রয় নেওয়া মোহাম্মদ আল-মাসরি বলেন, ‘আমরা ইফতারে কোনো প্রস্তুতি নিতে পারিনি। বাস্তুচ্যুতদের কী আছে? আমরা রমজানের আনন্দ অনুভব করতে পারছি না। ঠাণ্ডায় তাঁবুতে জমে যাওয়া মানুষগুলোর দিকে একবার তাকান।’ খান ইউনিস থেকে বাস্তুচ্যুত ওম মুহাম্মদ আবু মাতারও বলেন, চলতি বছর রমজানে রক্ত, দুঃখ, বিচ্ছেদ এবং নিপীড়নের স্বাদ পাচ্ছে গাজাবাসী।
এ মাসে যুদ্ধবিরতির কথা চললেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। আলোচনা পিছিয়ে গেছে বারবার। মধ্যস্থতাকারী কাতার মঙ্গলবার জানিয়েছে, গাজায় যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তি চুক্তির কাছাকাছি নেই ইসরায়েল ও হামাস। একই সঙ্গে পরিস্থিতি ‘খুবই জটিল’ বলে সতর্ক করেছে দেশটি।
রমজান শুরুর আগে একটি যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তি নিয়ে চুক্তির লক্ষ্যে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে চেষ্টা চালিয়ে আসছিল যুক্তরাষ্ট্র, কাতার ও মিশর। তবে রমজান শুরু হলেও বহুল প্রত্যাশিত যুদ্ধবিরতির কোনো সম্ভাবনা এখনও দেখা যায়নি।
এ পরিপ্রেক্ষিতে কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজেদ আল আনসারি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আমরা চুক্তির কাছাকাছি নেই। এর অর্থ আমরা উভয়পক্ষকে এমন কোনো একটা বিন্দুতে মিলিত হতে দেখছি না যাতে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য বর্তমানের মতপার্থক্য দূর করা সম্ভব।
তবে একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে সব পক্ষ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। তবে এটি কতদিনে সম্ভব হবে সেটির কোনো নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি।
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবিক সংস্থা গাজায় দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা প্রকাশ করলেও সেখানে পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানো যাচ্ছে না। ইসরায়েলি নিষেধাজ্ঞার কারণে স্থলপথে ত্রাণ প্রবেশ করতে পারছে না, তবে অল্পসংখ্যক ত্রাণবাহী জাহাজ গাজার উপকূলে ভিড়তে দেওয়া হচ্ছে। সাইপ্রাস থেকে গাজা পর্যন্ত একটি সামুদ্রিক করিডর ব্যবহার করে প্রথম ত্রাণবাহী জাহাজ রওনা হয়েছে সেখানে। মঙ্গলবার সাইপ্রাসের লারনাকা বন্দর ছেড়ে যায় জাহাজটি। অনেকে জাহাজটিকে আশার প্রতীক হিসেবে দেখছে। তবে একটিমাত্র ত্রাণবাহী জাহাজ গাজা অঞ্চলের কয়েক লাখ মানুষকে দুর্ভিক্ষের কবল থেকে রক্ষা করতে পারবে কি না সেটিই বড় প্রশ্ন।
হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, অপুষ্টি ও পানিশূন্যতার কারণে গাজায় অন্তত ২৩ জন মারা গেছে। যাদের অধিকাংশই শিশু। এ বিষয়ে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) প্রধান সিন্ডি ম্যাককেইন গত সোমবার বলেন, ‘আমাদের সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। যদি আমরা গাজার উত্তরাঞ্চলে ত্রাণের পরিমাণ দ্রুতগতিতে না বাড়াতে পারি, তবে দুর্ভিক্ষ আসন্ন।
গাজায় নিহত ৩১১৮৪, আহত ৭২৮৮৯
অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা ৩১ হাজার ১৮৪ জনে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া আহত হয়েছে ৭২ হাজার ৮৮৯ জন। মঙ্গলবার গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে।
জাতিসংঘের মতে, গাজার প্রায় ৮৫ শতাংশ বাসিন্দা খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি এবং ওষুধের তীব্র ঘাটতির সম্মুখীন হচ্ছেন। ইসরায়েলি আগ্রাসনে বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছে তাদের। এ ছাড়া গাজার ৬০ শতাংশ অবকাঠামো ইসরায়েলি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সংগঠন হামাস। হামলায় ইসরায়েলের এক হাজার ২০০ জন নিহত হয়। এরপর গাজায় সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে ইসরায়েল। ইতোমধ্যেই দেশটি আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে।