মিয়ানমারে জান্তা সরকারের সঙ্গে বিদ্রোহীদের সংঘাত আবারও বেড়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের কক্সবাজার সীমান্তবর্তী সংঘাতময় রাখাইন রাজ্যে সরকারি সেনা ও বিদ্রোহীদের মধ্যে এখনো লড়াই চলছে। গত কয়েকদিন ওই এলাকায় পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও শুক্রবার রাত থেকে পাল্টে গেছে পরিস্থিতি। ফের সেখানে মুহুর্মুহু গুলির শব্দ শোনা গেছে। আর শনিবার সকালে টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং সীমান্ত পয়েন্টের ওপার থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ভেসে আসতে দেখেছেন স্থানীয়রা। এদিকে সীমান্তে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধে সরকার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে কঠোর পাহারায় রয়েছে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি। তবে গোলযোগপূর্ণ রাখাইনে প্রাণে বাঁচতে টেকনাফ উপজেলার সব সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের উদ্দেশ্যে ঘোরাঘুরি করছে রোহিঙ্গারা। এ ছাড়া চাকমাসহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের মিয়ানমারের নাগরিকরাও সেখানে ভিড় করছেন। অনেকে নাফ নদী পার হয়েও অনুপ্রবেশের উদ্দেশ্যে নৌকায় আসছে। তবে বিজিবি এ বিষয়ে সতর্ক থাকলেও আতঙ্ক ও ঝুঁকিতে আছেন স্থানীয়রা।

হোয়াইক্যংয়ের স্থানীয় বাসিন্দা মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘ওপারে চলমান সংঘাত থেকে গুলির শব্দে গত দুই-তিন সপ্তাহে বাড়িতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারি নাই। গত কয়েকদিন পরিস্থিতি শান্ত হলেও গত রাতে আবার গুলির শব্দ শোনা গেছে।’

তিনি আরও জানান, সকাল থেকে হোয়াইক্যং বাজারের ব্রিজ থেকে রাখাইন সীমান্তবর্তী এলাকায় ধোঁয়ার কুণ্ডলি ভাসতে দেখা গেছে। তবে দিনের বেলায় গুলির শব্দ শোনা যায়নি।

টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ নুর আহমদ আনোয়ারী জানান, সীমান্তের ওপারে গুলির শব্দ শোনা গেছে। এর মধ্যেই আজ শনিবার সকালে হোয়াইক্যং ইউপির ২ নম্বর ওয়ার্ডের বাজারের ব্রিজ এলাকায় দাঁড়িয়ে ওপার থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলি ভেসে আসতে দেখা গেছে। এমন ঘটনায় সীমান্তের মানুষদের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক বিরাজ করছে।

তিনি আরও বলেন, ‌‘তবে সীমান্ত এলাকায় আমাদের বিজিবির সদস্যরা খুবই সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।’

এদিকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে দেশটির সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে গোলাগুলি ও সংঘর্ষ বাড়ায় এপারে নাফ নদী পেরিয়ে ঢোকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা। এতে ওই অঞ্চলের বাসিন্দারা ঝুঁকিতে রয়েছে।

কক্সবাজার টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপের নৌকার মাঝি আবু বক্কর বলেন, মিয়ানমারের সাগরের তীরে হাজার হাজার রোহিঙ্গার অবস্থান দেখা গেছে। কমপক্ষে ২০-২৫টি রোহিঙ্গাবোঝাই নৌকা দেখা যায়। সেসব নৌকা এপারে ঢোকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে বিজিবি ও কোস্ট গার্ডের ভয়ে তারা অনুপ্রবেশ করতে পারছে না।

স্থানীয় আরেক জেলে কবির আহমেদ বলেন, মিয়ানমার থেকে খবর নিয়ে জানা গেছে তাদের এলাকায় আরকান আর্মি ঢুকে পড়েছে, তাই সংঘর্ষ বেড়ে যাওয়ায় তাদের অন্য জায়গায় আশ্রয় নিতে বলা হয়েছে। তাই কয়েক হাজার রোহিঙ্গা প্রাণে বাঁচতে বিলে, সাগরের তীরে আশ্রয় নিয়েছে। তারা কোন মুহূর্তে নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করবে জানি না। রাতের বেলায় এদের শাহপরীর দ্বীপসহ বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ করার আশঙ্কাও করছেন তিনি। রোহিঙ্গাদের সম্ভাব্য অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বিজিবি ও কোস্টগার্ড।

এদিকে বিস্ফোরণের শব্দে কম্পিত হচ্ছে টেকনাফ সীমান্তের হ্নীলা, সাবরাং ও সেন্ট মার্টিনে নাফ নদের বিপরীতে মিয়ানমার সীমান্তে প্রতিদিনই গোলাগুলি-মর্টার শেলের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। প্রায়ই হ্নীলার জাদিমুড়া, দমদমিয়া, মৌলভীবাজার, ফুলের ডেইল সাবরাংয়ের নয়াপাড়া, মৌলভীপাড়া, নাজিরপাড়া, শাহপরীর দ্বীপের জালিয়া পাড়া, পৌরসভার জালিয়াপাড়া, চৌধুরীপাড়া, দক্ষিণ জালিয়াপাড় এলাকার নাফ নদের সীমান্তে থেমে থেমে ভারি গুলিবর্ষণের বিকট শব্দ শুনতে পান তারা।

মিয়ানমার মংডুর সিকদার পাড়ার রোহিঙ্গা মো. সেলিম জানান, আমাদের তিনটি গ্রাম ধ্বংস হয়ে গেছে আমরা প্রাণে বাঁচতে ঘরবাড়ি ছেড়ে চরে আশ্রয় নিয়েছি। সাগরের বাংলাদেশের বাহিনী বেশি থাকা সেখানে আশা সম্ভব হচ্ছে না। তবে আমরা চেষ্টা করব সেখানে ঢোকার নাইলে আমরা বাঁচতে পারব না। আমরা বেশি আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি। এখন সংঘর্ষ বেড়ে চলছে এ মুহূর্তে। ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। হেলিকপ্টার থেকে বোমা মারতেছে। আমাদের কয়েকটি গ্রাম থেকে গোলাগুলি হচ্ছে, গ্রাম গুলো হচ্ছে, মংডু কাদিরবিল, নুরুল্যাহ পাড়া, বাগগুনা, নর বাইন্যা, থানাশো। এসব এলাকা থেকে রোহিঙ্গা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে।

এ বিষয়ে টেকনাফ ২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ জলসীমাজুড়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিজিবির টহল জোরদার করা হয়েছে। সার্বক্ষণিক স্পিড বোট দিয়ে টহল দেওয়া হয়। কোনো অনুপ্রবেশকারীকে ঢুকতে দেওয়া হবে না।