প্রতিবছরই কোন কোন ঝড়ের কবলে পড়তে হচ্ছে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোকে। প্রতিনিয়ত দুর্যোগের ফলে জান-মাল রক্ষার সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হচ্ছে ওই অঞ্চলের বাসিন্দাদের।
এবছরও প্রবল শক্তি নিয়ে উপকূলে আঘাত করতে যাচ্ছে ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’। খুলনা আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ আমিরুল আজাদ বলেন, ‘রোববার সকাল ৬টা থেকে ঝড়ের অগ্রভাগে অংশের প্রভাব শুরু হয়। ধীর ধীরে প্রভাব বাড়ছে। মধ্যে রাতে সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেহাটের উপকূলে প্রবল বেগে আঘাত করবে বলে পূর্বাভাস রয়েছে। ঝড়ের প্রভাবে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৮ থেকে ১২ ফুটের বেশি জলোচ্ছ্বাসে উপকূল প্লাবিত হতে পারে।’
ঝুকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ নিয়ে শঙ্কা
ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে বিশেষ করে ঝুকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে উপকূলের মানুষ। আগের বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগে গৃহহারা হয়ে বেড়িবাঁধ অথবা উচু কোন স্থানে টং ঘর বেধে বসবাসকারি লোকেরা ফের বেড়িবাঁধ ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে।
এ বছর খুলনা, বাগেরহাটে ও সাতক্ষীরা জেলার মধ্যে সব থেকে ঝুকিতে রয়েছে সাতক্ষীরা জেলা। সেখানের পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ খুবই দুর্বল রয়েছে। ফলে ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস থেকে ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ রক্ষায় নিজেরাই কাজ শুরু করে দিয়েছেন স্থানীয়রা।
আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের সুভদ্রাকাটি গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ মেরামতে গতকাল শনিবার রাত থেকে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছে গ্রামবাসি। রাতে আলো জ্বালিয়ে তারা ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামতে মাটির কাজ করেছেন।
আশাশুনি উপজেলার বিছট গ্রামের রুহুল আমিন মোড়ল জানান, রোববার সকাল থেকে হালকা বৃষ্টির সঙ্গে দমকা বাতাস বইতে শুরু করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ নিয়ে আতঙ্কে রয়েছে গ্রামের অধিকাংশ মানুষ। যেনতেনভাবে সংষ্কার করা পাউবো’র এই বেড়িবাঁধ ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের কারণে যেকোন মুহূর্তে ভেঙে যেতে পারে।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী এম সালাউদ্দীন বলেন, ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সুন্দরবন সংলগ্ন নদ-নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে তিন থেকে চার ফুট পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। শ্যামনগরকে ঘিরে থাকা উপকূল রক্ষা বাঁধের প্রায় ১২৯ কিলোমিটারের মধ্যে সাত/আটটি পয়েন্টের প্রায় দুই কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ। ইতিমধ্যে মাটি ফেলে উচ্চতা বৃদ্ধিসহ জিও ব্যাগ ডাম্পিং করে বাঁধের ভাঙন ও ধস ঠেকানোর কাজ চলছে।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ মনিরুল ইসলাম বলেন, বিভাগের আওতাধীন ১৫ এর অধিক পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ঝুকিপূর্ণ রয়েছে। এই মুহুর্ত্বে ৫/৬টি পয়েন্টে কাজ চলছে। পর্যাপ্ত জিও ব্যাগ ও জিও রোল মজুদত রয়েছে। এখন আমরা ৭/২ পোল্ডারের বিছট গ্রামের ভাঙন পয়েন্টে বেড়িবাঁধে জিও রোলের কাজ করছি। পর্যায়ক্রমে সবগুলো পয়েন্টে কাজ করা হবে বলে জানান তিনি।
ক্ষত মোকাবিলায় প্রস্তুতি
খুলনা জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন জানান, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার জন্য ৬০৪টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। যাতে পরিস্থিতি অনুযায়ী ঝুঁকিপূর্ণ লোকজন সেখানে আশ্রয় নিতে পারেন। এসব সাইক্লোন শেল্টারে মোট ৩ লাখ ১৫ হাজার ১৮০ জন মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। এছাড়া ৩টি মুজিব কিল্লায় ৪৩০ জন মানুষ আশ্রয় ও ৫৬০টি গবাদি পশু রাখা যাবে। কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা উপজেলায় ৫ হাজার ২৮০ জন স্বেচ্ছাসেবককে প্রস্তুত রয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক হুমায়ুন কবির বলেন, ঘূর্ণিঝড় রেমাল মোকাবেলায় সংশ্লিষ্ট সব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের স্টেশন ত্যাগ না করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই সময়ে এ মৌসুমে একটি সাধারণ প্রস্তুতি আমাদের থাকেই।
তিনি বলেন, সাতক্ষীরায় ১৮৭টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রয়েছে। এসব সাইক্লোন শেল্টারে ৪ লাখ ৪৩ হাজার ৫০০ জন মানুষ আশ্রয় নিতে পারবেন। এ ছাড়া জরুরি ত্রাণ কার্যে ব্যবহারের জন্য ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা মজুদ রয়েছে। একইসঙ্গে ৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবকসহ স্বাস্থ্য বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, ও কোস্টগার্ড কাজ করবে।
এছাড়া বাগেরহাট জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় ৩৫৯টি আশ্রয়কেন্দ্র ,৩ হাজার ৫০৫ জন স্বেচ্ছাসেবক, ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও ৬৪৩.৪০০ মেট্রিক টন চাল মজুত রয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোহা. খালিদ হোসেন।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স খুলনার উপপরিচালক মামুন মাহমুদ বলেন, ঘূর্ণিঝড় রেমাল মোকাবেলায় খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের ৩০টি টিম গতকাল শনিবার সকাল ৬টা থেকে কাজ শুরু করেছে। এর মধ্যে খুলনায় ১৪টি, বাগেরহাটে ১০টি এবং সাতক্ষীরায় ৬টি ফায়ার স্টেশনের টিম কাজ করছেন। টিমের সদস্যরা মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি রেসকিউ, বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা, নিরাপদে আশ্রয়কেন্দ্রে আনাসহ যাবতীয় কাজ করবে। জল ও স্থল উভয় পথে ফায়ার সার্ভিসের টিম এবং যাবতীয় সরঞ্জাম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। খুলনা সদরদপ্তরে স্ট্যান্ডবাই রাখা হয়েছে ২০ সদস্যের স্পেশাল টিম। খোলা হয়েছে মনিটরিং সেল।
সুন্দরবনে বাড়তি সতর্কতা
সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) এ কে এম ইকবাল হোসাইন চৌধুরী বলেন, সাতক্ষীরা রেঞ্জের চারটি স্টেশনসহ সকল টহলফাঁড়িতে অবস্থানরত বনকর্মীদের সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া সুন্দরবন ও সাগরে মাছ শিকারে যাওয়া জেলেদের লোকালয়ে ফিরতে পরামর্শ দিয়ে তাদের উদ্ধারে বনকর্মীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মোহাম্মদ নূরুল করিম জানান, ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসার খবরে বনবিভাগের সব কর্মকর্তা ও বনরক্ষীদের ছুটি বাতিল করে তাদের নিরাপদ থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রে বাড়তি সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির বলেন, করমজল বন্যপ্রাণী ও প্রজনন কেন্দ্রের বন্যপ্রাণীদেরও নিরাপদে রাখা হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে সার্বক্ষণিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রয়োজনীয় আরও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
মোংলা বন্দরের অপারেশন কার্যক্রম বন্ধ
ঘূর্ণিঝড় রেমাল মোকাবিলায় মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন প্রস্তুতি নিয়েছে। মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল শাহীন রহমান বলেন, এই মুহূর্তে মোংলা বন্দরের হারবাড়িয়ায় ৪ টি জাহাজ, বেসক্রিক এরিয়ায় ১টি ও জেটিতে ২ টি জাহাজসহ মোট ৬টি বিদেশি জাহাজ রয়েছে। ঝড় থেমে না যাওয়া পর্যন্ত মোংলা বন্দরের সকল প্রকার অপারেশন কার্যক্রম বন্ধ রাখা হবে।
তিনি বলেন, বাণিজ্যিক সকল জাহাজগুলোকে জেটির পাশ ত্যাগ করে চ্যানেলের বিভিন্ন পয়েন্টে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে নোঙ্গর করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। মোংলা বন্দরের নিজস্ব জলযান সমূহকে ২ টায়ারে বিদ্যমান বার্থসমূহে নিরাপদে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এছাড়া বন্দর চ্যানেলকে নিরাপদে রাখার জন্য দেশি কার্গো ও লাইটারেজগুলোকে চ্যানেলের বাইরে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। বন্দরে আমদানিকৃত গাড়ি নিরাপদে রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে ও আমদানিকারকদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
উপকূলে বাববার আঘাত
আবহাওয়া অফিসের তথ্য মতে, গত ১৫ বছরে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে উপকূলে। তার মধ্যে রয়েছে, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরে সিডর, ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলা, ২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেন, ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই কোমেন, ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়ানু ও ২০১৭ সালের ৩০ মে মোরা, ২০১৯ সালের ৪ মে ফণী, ২০১৯ সালের ১০ নভেম্বর বুলবুল, ২০২০ সালের ২০ মে আম্পান, ২০২১ সালের ২৬ মে ইয়াস এবং ২০২১ সালের ৪ ডিসেম্বর ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদ ও সর্বশেষ ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবর উপকূলে আঘাত হানে সিত্রাং। এই ১৫ বছরে সব থেকে বেশি ক্ষতি হয়েছে সিডর ঝড়ে।
খুলনা আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ আমিরুল আজাদ বলেন, ‘বাংলাদেশর হতিহাসে অন্যতম পাঁচটি বড় ঝড়ের মধ্যে হল একটি সিডর। এ ঝড়ে বাংলাদেশের খুলনা ও বরিশাল বিভাগ সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। এর মধ্যে খুলনার দাকোপ উপজেলার কালাবগি এলাকা ও বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার সাউথখালী এলাকা সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। এছাড়াও সুন্দরবনের বেশ ক্ষতি হয়েছিল। আঘাতের সময় সিডরের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার। এর প্রভাবে উপকূলে ১০ থেকে ১৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়েছিল।’
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক দিলীপ কুমার দত্ত বলেন, ‘বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই অঞ্চলে প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দুর্যোগ হচ্ছে।’