বুধবার, ৩০ জুলাই ২০২৫, ১০:২৩ অপরাহ্ন

ভাষা আন্দোলন: বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা

লেখক: শিশু সাহিত্যিক / ৭৮ বার দেখা হয়েছে
প্রকাশিত : বুধবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

প্রতিটি শিশুই জন্মের সময় চিৎকার দিয়ে মায়ের উদর থেকে পৃথিবীতে আগমন ঘটে। ও যেন কান্নার ভাষায় জানিয়ে দেয়, অন্যকোনো ভুবন থেকে হঠাৎ স্থান বদলের এই উপাখ্যান মানতে রাজি নয়। তারপরও দিন যায় সময়ের হাত ধরে। মায়ের বুকের নির্যাস টেনে বড় হয় শিশু। মুখে আসে মায়ের বুলি। মাকে চিৎকার করে দৌড়ে এসে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে দুরন্তপনায়। মাকে মা, বাবাকে বাবা, প্রিয়াকে প্রিয়তমা বলে ডাকার মাতৃভাষা বুকের ভিতর থেকে নিংড়ে আসে। এই ভাষাও সহজে পায়নি বাঙালি জাতি। এর জন্যও রক্ত দিতে হয়েছিল, খালি হয়েছিল মায়ের কোল। মাতৃভাষা রক্ষার অধিকার আদায়ে ঢাকার কালো পিচঢালা রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিল রক্তের শোণিত ধারায়। সে কথা জানতে পিছনে ফিরে যেতে হয়, ইতিহাসের পাতা ধরে।

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে সেনাপতি মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলার পরাজয় ও মর্মান্তিক মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয় বেনিয়া ইংরেজ শাসনের গোড়াপত্তনে। ইংরেজদের তাড়াতে স্বদেশি হলো, ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ, ফকির সন্ন্যাস বিপ্লব, জাঁসীর রাণী, টিপু সুলতান, ক্ষুদিরাম, মাস্টারদা সূর্য সেন, প্রীতিলতা সর্বোপরী নেতাজি সুবাস বসুর আন্দোলন। অবশেষে ১৯৪৭ সালে ইংরেজরা ভারত উপমহাদেশ ছেড়ে চলে যায়। ভারতবর্ষ ভাগ হয় ভারত ও পাকিস্তান নামে। বিভক্তির অন্যতম ধারণা ছিল দ্বিজাতি তত্ত্ব। দ্বিজাতি তত্ত্ব হলো হিন্দু ও মুসলিম জাতিতে বিভক্তি। এখানে ভাষা, বর্ণ বা অন্যকোনো দিক বিবেচিত না হয়ে কেবল ধর্মকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। যে স্বপ্ন আশা নিয়ে দেশভাগ হয়েছিল, তার স্বপ্ন ধূলিস্মাৎ হয়। পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র হলেও পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের প্রতি বৈষম্য, নিপীড়ন, অর্থনৈতিক ও মানসিকভাবে দাবিয়ে রাখে। পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা তখন চলে আসে মুসলিমলীগের হাতে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ হলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। লিয়াকত আলী খান হলেন প্রধানমন্ত্রী। পশ্চিমারা পূর্ব পাকিস্তানের ওপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের প্রথম আঘাতটা আনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার ষড়যন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে। ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতি জ্ঞানতাপস ড. মহম্মদ শহীদুল্লাহ তার ভাষণে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে বাঙালির বাঙালিত্ব ধরে রেখে পরোক্ষভাবে বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষার পক্ষে কথা বলেন। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেন। ওই অধিবেশনে কুমিল্লার কংগ্রেস সদস্য ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত বাংলা ভাষা ব্যবহারের পক্ষে একটি সংশোধনী প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। তার যুক্তি হলো পাকিস্তানের ৬ কোটি ৯০ লাখ জনগণের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ৪ কোটি ৪০ লাখ জনগণের ভাষা হলো বাংলা। কাজেই সংখ্যা গরিষ্ঠ লোকের ভাষাই রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনও উর্দুর পক্ষ অবলম্বন করেন। ১১ মার্চ ১৯৪৮ গণপরিষদে প্রস্তাব পাস হয়, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। ১১ মার্চ পূর্ব বাংলায় ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস’ উপলক্ষে ধর্মঘট পালিত হয়। ছাত্রদের আন্দোলনে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হন। ১৫ মার্চ জেল থেকে মুক্তি পান শেখ মুজিব। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে তৎকালীন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের এক জনসভায় ঘোষণা দেন, ‘Urdu and Urdu shall be the state language of Pakistan মানে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সমাবর্তন অনুষ্ঠানেও একই বক্তব্য দিলেন জিন্নাহ, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।’ তীব্র প্রতিবাদে বাঙালি ছাত্ররা ক্ষেপে ওঠে। ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান তার দলবল নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে বলেন, ‘নো, নেভার, জিন্নাহ সাহেবের ঘোষণা মানব না। উর্দুকে কিছুতেই রাষ্ট্রভাষা করতে দেওয়া হবে না। আমরা জান দেবো, জবান দেবো না।’ জিন্নাহ সাহেব ভাবতেও পারেননি, তার বক্তৃতার সরাসরি এমন এভাবে চলতে থাকে। মৌলিক অধিকার রক্ষায় জাতিকে একত্রীভূত করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে শেখ মুজিব তার কারিশমাটিক নেতৃত্ব চালিয়ে যান। ১৯৫২ সালে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদে ছাত্রসমাজ এক হয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। শেখ মুজিব কারাগারে থেকেও সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সঙ্গে কারাগারে দিকনির্দেশনা দেন। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। ছাত্রসমাজ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিলসহ এগিয়ে যায়। ঢাকা মেডিকেল সংলগ্ন জায়গায় তাদের ওপর গুলি চালায় পুলিশ। অনেকেই শহীদ হন; কিন্তু পুলিশ তাদের মরদেহ গুম করে ফেলে। পরিচয় পাওয়া কয়েকজন ভাষা শহীদদের মধ্যে সালাম, রফিক, আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, শফিউর রহমানের নাম উল্লেখযোগ্য। পৃথিবীতে ভাষার জন্য রক্তদানের ঘটনা একমাত্র বাংলাদেশেই। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের চেতনা সাহস ও শক্তি জুগিয়েছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে। বাঙালি হয়েছে বাঘা বাঙালি।

১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর সাধারণ পরিষদের ৩০তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে বাংলাদেশসহ আরও ২৭টি দেশের সমর্থন নিয়ে সর্বসম্মতিক্রমে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। আজকের প্রজন্ম ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে যে বাংলিশ ভাষা ব্যবহার করছে, তার ভবিষ্যৎ ভালো নয়। ফলে না পারছে সঠিকভাবে বাংলা বা ইংরেজি ভাষার রপ্ততা। জাতিসংঘের অধিবেশনে প্রথম বাংলায় ভাষণ দেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জুলিওকুরি উপাধি প্রাপ্ত বিশ্বনেতা, স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৭ থেকে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় সংঘটিত সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিত দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া জাতি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। যা ১৯৭১ সালে বাঙালি তার স্বাধীনতা পেতে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, পৌনে তিন লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে এনে দিয়েছিল লাল সবুজের পতাকা। ভাষা আন্দোলন থেকে ফিডব্যাক পাওয়া বাঙালি গর্জে উঠেছিল স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনার যুদ্ধে, তারই ফলাফল বিশ্ব মানচিত্রে জ্বল জ্বল করা আমার বাংলাদেশ।

লেখক: শিশু সাহিত্যিক


আরো সংবাদ পড়ুন...
এক ক্লিকে বিভাগের খবর