রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজে নিয়োজিত এক রুশ নারী তার ১৫ বছরের মেয়েকে নিয়ে রাজধানীর কল্যাণপুরে অবস্থিত ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। রুশ ওই নারীর মেয়ের শরীরে একটি ফোঁড়া হওয়াতে সেটির চিকিৎসা করাতে গত ৮ ফেব্রুয়ারি ইবনে সিনা হাসপাতালে যান। নামিদামি হাসপাতাল মনে করে মেয়ের চিকিৎসার জন্য নিয়ে গেলেও সেখানে তাদের সম্মুখীন হতে হয় ভয়াবহ এক ঘটনার। আবুল কাশেম নামে ইবনে সিনার এক ওয়ার্ড বয় ওই রুশ নারীর মেয়েকে চিকিৎসার নামে নানাভাবে শ্লীলতাহানি করেন বলে অভিযোগ উঠে।
এ ঘটনায় গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ওই রুশ নারী ওয়ার্ড বয় কাশেমকে আসামি করে রাজধানীর মিরপুর মডেল থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় কাশেমকে ওই দিনই গ্রেপ্তার করে পুলিশ। কাশেম বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন বলে জানা গেছে।
ভুক্তভোগী ওই নারী মামলার এজাহারে অভিযোগ করে বলেন, তিনি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজে নিয়োজিত। তার মেয়ের ডান হাতের বগলের নিচে একটি ফোঁড়ার অস্ত্রোপচারের জন্য গত ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর কল্যাণপুরের ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন।
ভর্তির পর হাসপাতালের ১৪০৯ নম্বর কক্ষ দেওয়া হয় তাদের। এই কক্ষের পাশেই ছিল হাসপাতালের নার্সদের স্টেশন। ওই দিন রাত ২টার দিকে ইবনে সিনা হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. আনোয়ার ভিকটিমকে দেখতে যান। এসময় ডা. আনোয়ারের সঙ্গে নীল ইউনিফর্ম পরে আবুল কাশেম নামে একজন ব্যক্তি আসেন।
এসময় ভিকটিমের ফোঁড়াটি দেখতে চান ডা. আনোয়ার। ফোঁড়াটি যেহেতু সংবেদনশীল জায়গার কাছাকাছি ছিল তাই সেটি দেখাতে একটু বিব্রতবোধ করছিলেন ভিকটিম। এই জন্য ডা. আনোয়ার আবুল কাশেমকে বলেন একজন নার্সকে ডেকে আনতে। নার্স আসার পর ভিকটিম তার ফোঁড়াটি দেখান। ফোঁড়া দেখানোর সময় কাশেম কক্ষের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন।
ফোঁড়া দেখার পর কক্ষ থেকে ডা. আনোয়ার আর নার্স চলে যান। চিকিৎসক যাওয়ার ১০ মিনিট পর নীল গাউন পরে কাশেম একা ১৪০৯ নম্বর কক্ষে আসেন। কক্ষে ফিরে কাশেম ওই রুশ নারীকে জিজ্ঞাসা করেন তার মেয়ের আগে কোনো ফোঁড়া ছিল কি না। তাদের এই কথোপকথন গুগল ট্রান্সলেটের মাধ্যমে হয়।
তিনি কাশেমকে বলেন তার মেয়ের আগেও ফোঁড়া ছিল। তখন কাশেম ভিকটিমের ফোঁড়াটি আবার দেখতে চান। পরে ভুক্তভোগী তরুণী তার কাপড় খুলে কাশেমকে ফোঁড়া দেখায়। তখন কাশেম ফোঁড়ার দিকে তাকিয়ে বলে খুব খারাপ অবস্থা! এরপর কাশেম কক্ষ থেকে বের হয়ে যায়।
এর ঠিক কিছুক্ষণ পরে কাশেম একটি মলম নিয়ে এসে ভুক্তভোগী তরুণীর মাকে বলে ফোঁড়ার ক্ষতস্থানে মলম লাগাতে হবে। কাশেমের কথা শোনে ভুক্তভোগী তরুণী তার শার্ট খুলে ক্ষতস্থান উন্মুক্ত করে। তখন কাশেম ভিকটিমের স্পর্শকাতর স্থান থেকে কাপড় সরানোর চেষ্টা করেন। এরপর রাত ৩টার দিকে কাশেম আবারও কক্ষে আসেন ক্ষতস্থানে আরও একটি মলম লাগানোর জন্য।
এসময় ভুক্তভোগী তরুণী ও তার মা ঘুমিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তখন কাশেম ভুক্তভোগী তরুণীর টি-শার্ট তুলে শুধু ফোঁড়া নয়, তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় স্পর্শ করছিল। সর্বশেষ কাশেম মলম লাগানোর কথা বলে ভিকটিমের স্পর্শকাতর জায়গায় হাত দেয়। তখনো ভিকটিম ও তার মা বুঝতে পারেননি কাশেম একজন ওয়ার্ড বয়, চিকিৎসক নন।
এজাহারে ওই রুশ নারী আরও অভিযোগ করেন, রাত সাড়ে তিনটার দিকে কাশেম মশার স্প্রে নিয়ে ভিকটিমের কক্ষে প্রবেশ করেন। কাশেমের মশার স্প্রে নিয়ে আসা দেখে ভিকটিমের মার সন্দেহ হয় যে তিনি চিকিৎসক নন। তখন কাশেমকে কক্ষ থেকে বের হয়ে যেতে বলেন ভুক্তভোগীর মা। পরের দিন সকাল সাড়ে ৬টায় কাশেম আবারও এসে তাদের ঘুম থেকে উঠিয়ে চিকিৎসার কথা বলে ভুক্তভোগীর মাকে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন। কারণ তিনি কক্ষে থাকলে চিকিৎসায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে বলে জানান কাশেম।
কাশেমের মনোভাব বুঝতে পেরে ভুক্তভোগীর মা তাকে কক্ষ থেকে বের করে দেন। এরই মধ্যে ভিকটিমের মার চিৎকার শোনে পাশে থেকে দুইজন নার্স আসেন। পরে ভিকটিমের মা অভিযোগ করেন, চিকিৎসার নামে কাশেম তার মেয়ের সংবেদনশীল স্থান স্পর্শ করেছেন।
পরে ভিকটিমের মা পাশে থাকা নার্সদের স্টেশনে যান। সেখানে গিয়ে কাশেমের বিষয়ে জানতে চান। তখন নার্সরা ভিকটিমের মাকে অনুরোধ করেন কাশেমকে ক্ষমা করে দিতে। না হলে তাদের চাকরি চলে যাবে। এরই মধ্যে চিকিৎসকরাও বিষয়টি জেনে যান। চিকিৎসকদের বিষয়টি জানান ভিকটিমের মা। তখন ডাক্তাররা ভিকটিমের মাকে বলেন লিখিত অভিযোগ করতে। তখন তিনি কাশেমের বিষয়ে একটি লিখিত অভিযোগ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে দেন।
পরে ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিনিয়র এজিএম ও অ্যাডমিন ইনচার্জ মোহাম্মদ নুরে আলম (সবুজ) কক্ষে প্রবেশ করে ভিকটিমের মাকে বলেন, তার অভিযোগ গ্রহণ করা হয়েছে। তারা এই ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। এছাড়া কাশেমকে বরখাস্ত করা হয়েছে বলেও তিনি জানান।
এ বিষয়ে জানতে ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিনিয়র এজিএম ও অ্যাডমিন ইনচার্জ মোহাম্মদ নুরে আলমকে (সবুজ) ফোন করা হলে তিনি বলেন, এ ঘটনায় আমরা দুটি তদন্ত কমিটি করেছি। তদন্ত করে আমরা খুব দ্রুত সময়ে কাশেমকে বরখাস্ত করি। আরও একটি তদন্ত প্রতিবেদন আমাদের হাইয়ার অথরিটিকে পাঠিয়েছি।
কাশেম ছাড়া এ ঘটনায় হাসপাতালের আর কেউ জড়িত কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ঘটনার দায় শুধু কাশেমের। তিনি অফিসের নিয়মও ভঙ্গ করেছেন। এখানে প্রতিষ্ঠানের কোনো দায় নাই, দায় ব্যক্তির।
এদিকে মামলার তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. নাসির আহমেদ বলেন, গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ওই রুশ নারী মামলাটি করেন। মামলার দিনই আমরা কাশেমকে গ্রেপ্তার করি। তিনি বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। যদিও কাশেম তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ স্বীকার করেননি। তবে আমাদের তদন্ত চলমান রয়েছে।