সুফিয়া বেগম, বয়স ৫০ এর বেশি। জীবিকার তাগিদে হাতে তুলে নিয়েছেন নৌকার বৈঠা। সেই ভোরে হাতে ওঠে বৈঠা আর শেষ হয় রাতে। ৬ বছর ধরে নৌকা চালিয়ে ৭ জনের সংসার চালাচ্ছেন তিনি। মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলা কাঠাবিল গ্রামের ধলাই নদীর তীরের জয়নাল মিয়ার স্ত্রী সুফিয়া বেগম। একসময় স্বামী ধলাই নদীর বুকে নৌকা চালিয়ে জীবিকা অর্জন করতেন।
কাঁকডাকা ভোরে ধলাই নদী পাড়ে চলে যান সুফিয়া বেগম। এরপর শুধুই বৈঠা বাওয়া। আদমপুর ইউনিয়নের কেওয়ালী ঘাট গ্রামের ধলাই নদীর পাড়ে। আদমপুর, ইসলামপুর ও মাধবপুর ইউনিয়নের দুই পাড়ের বসবাসকারীরা নৌকায় আসা যাওয়া করে করায় তিন ইউনিয়ন বাসিন্দাদের নদী পারের একমাত্র ভরসা সুফিয়ার নৌকা।
কথা হলে সুফিয়া বেগম এ প্রতিবেদককে জানান,‘ নদীর পাড়ে বসবাসকরী জীবিকার জন্য নৌকা নিয়ে দুই পাড়ে বসবাসকারীদের পাড়াপাড় করে থাকি। যা রোজগার হয় তা দিয়েই সংসার চলে। ঝুঁকি নিয়ে কোন রকম সংসার চালাচ্ছি। প্রতিদিন নৌকা চালিয়ে ৩ থেকে ৪শ’ টাকা হয়। তা দিয়েই অনেক কষ্ট করে চলে সংসার।’
তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী ও ছেলের ঘরের নাতি সে আমায় সাহায্য করে মাঝে মাঝে। নাতি প্রাইমারী স্কুলে পড়াশোনা করে ৫ম শ্রেণীতে। স্কুল থেকে খেয়েই চলে আসে ধলাই নদীর পাড়ে। সেখানে এসে আমায় সাহায্য করে। তা না হলে আমার আরও কষ্ট হত।’
এলাকাবাসীরা জানান, ‘ধলাই নদীর দুই পাড়ের সবাই এই নৌকার উপর নির্ভরশীল। কষ্ট করে নৌকা বেড়ে খাচ্ছে, তাছাড়া তো ওনার উপায় নেই। উনি চলবেন কি করে, খুবই অসহায়। শুধু বোঝেন, ভাঙ্গা নৌকা নিয়েই ঝড়-ঝঞ্জা উপেক্ষা করে এগিয়ে যেতে হবে। সহৃদয়বান মানুষ যদি একটু সহায়তার হাত বাড়ান, তাহলেই হয়তো সহজ হবে সুফিয়ার।
একই গ্রামের সুরুজ আলী নামের অপর এক বাসিন্দা বলেন, ‘দীর্ঘ দিন ধরে এখান থেকে আমরা নৌকায় উঠি। নৌকায় মানুষ পারাপার করে উনি (সুফিয়া বেগম) যে পরিমাণ টাকা পান তাতে তার পক্ষে সংসার চলতে খুবই কষ্ট হয়। সমাজের বিত্তবানরা যদি একটু তাদের পাশে দাঁড়ান তাহলে এই পরিবারটির অনেক উপকার হবে।’
ভ্রমণে আসা সোহেল রানা, আব্দুর রাজ্জাক, এম এ ওয়াহিদ রুলু ও শাহাবুদ্দিন বলেন, ‘জীবনের শেষ সময়ে এমন একজন নারীর নদীকেন্দ্রীক ব্যতিক্রমী পেশা গড়ে ওঠা সত্যিই বড় প্রসংসার। তার জীবন থেকে অনেকেরই শিক্ষা নেওয়া উচিত।’
নৌকা পাড়াপাড়ের বিষয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল হোসেন এ প্রতিবেদককে জানান, ‘সরকারি নিয়ম অনুসারে নৌকা পাড়াপাড়ের বিষয়ে লিজ নিতে হয় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে। কিন্তু সুফিয়া ও জয়নাল মিয়া আমার ইউনিয়নের বাসিন্দা খুবই গরীব।তারা যে সরকারি লিজ নিয়ে নৌকা পাড়াপাড় করবে সে টাকাও তাদের নাই। আমি নিজের প্যাকেট থেকে টাকা দিয়ে লিজ দেখিয়ে তাদের সহযোগীতা করেছি। যদিও ভালোভাবে সংসার এই টাকায় চলার কথা না তবু কোনো রকম নৌকা চালিয়ে সংসার চালাতে পারছে। এছাড়াও আমার ইউনিয়ন পরিষদ থেকে প্রায় সময় তাদের সহযোগীতা করে থাকি।’
কমলগঞ্জ উপজেলা মহিলা অধিদপ্তরের মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা হোসনে আরা বলেন, ‘নারী হয়ে তিনি ( সুফিয়া বেগম) যেভাবে নৌকা চালিয়ে জীবিকা অর্জন করছেন তা সত্যি প্রশংসার দাবিদার। তিনি যদি সহযোগিতা চান আমরা মহিলা পরিষদ থেকে যতটুকু সহযোগিতা করা দরকার তাকে সার্বিকভাবে তা করব।’
কমলগঞ্জ উপজেলা নিবার্হী অফিসার জয়নাল আবেদীন জানান, ‘সুফিয়া বেগম আমার কাছ সহযোগীতা চাইলে তাদের করবো।’