শুক্রবার, ৩০ মে ২০২৫, ০১:২৭ অপরাহ্ন

রোগীর রিপোর্ট ছুড়ে মারেন চিকিৎসক, ধমক দিয়ে বের করে দেন পরিচালক

অনলাইন ডেস্ক / ৫৬ বার দেখা হয়েছে
প্রকাশিত : সোমবার, ১০ জুন, ২০২৪
ডা. মো. আলাউদ্দিন শিকদার (বাঁয়ে) ও ডা. গৌতম কুমার পাল। কোলাজ

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের হতদরিদ্র মানুষের চিকিৎসার অন্যতম আশ্রয়স্থল খুলনা মেডিক্যাল কলেজ (খুমেক) হাসপাতাল। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যথাযথ তদারকি ও চিকিৎসকদের জবাবদিহিতার ঘাটতি থাকায় সেখানে সেবা পেতে রোগীদের প্রতিনিয়ত নানা রকমের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। চিকিৎসকদের এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার পাচ্ছেন না সাধারণ রোগীরা।

গত ২৮ মার্চ খুমেক হাসপাতালের বহির্বিভাগ থেকে চিকিৎসা সেবা নিতে গিয়েছিলেন খুলনা মহানগরীর সোনাডাঙ্গা থানাধীন হাফিজ নগর এলাকার বাসিন্দা মাহমুদা বেগম। সেবা নিতে গিয়ে তিনি চিকিৎসার বদলে হেনস্তার শিকার হয়েছেন।

তার স্বামী মো. মিন্টু মাতুব্বর বলেন, আমার স্ত্রীর পায়ের ব্যথা হয়েছিল। তাই খুমেক হাসপাতালে গিয়েছিলাম। বহির্বিভাগ থেকে টিকিট কাটলে আমাকে পাঠানো হয় ৩১০ নম্বর কক্ষে ফিজিক্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মো. আলাউদ্দিন শিকদারের কাছে। তিনি আমার স্ত্রীর রোগ নির্ণয়ের জন্য সিবিসি, আরবিএস ও এমআরআই টেস্ট করার পরামর্শ দেন। পরে এক ব্যক্তিকে দেখিয়ে বলেন, কোথা থেকে টেস্টগুলি করাতে হবে তার কাছ থেকে শুনে নিতে।

তিনি বলেন, সেই ব্যক্তি আমাকে একটি খুলনার পপুলার ডায়াগস্টিক সেন্টারে যাওয়ার পরামর্শ দেন। তবে আমার কাছে টাকা পর্যাপ্ত টাকা না থাকায়, আমি খুমেক হাসপাতালে থেকে কম খরচে মেডিক্যাল টেস্টগুলো করি। পরবর্তীতে ২৫ এপ্রিলে সকাল ১০টার দিকে ওই চিকিৎসকে টেস্টের রিপোর্ট দেখাতে গিয়ে চরম হেনস্তার শিকার হই।

মিন্টু মাতুব্বর বলেন, রিপোর্ট দেখে প্রথমে ডাক্তারা জিজ্ঞাসা করেন সরকারি হাসপাতাল থেকে কে এই টেস্ট করাতে বলেছে। তারপর আমার স্ত্রীর রিপোর্টের ফাইল ধরে ছুড়ে মেরে বলেন, এটা আমি দেখব না। তখন কোনো ধরনের প্রেসক্রিপশন বা পরামর্শ না দিয়ে রুম থেকে অপমান করে বের করে দেন।

সরকারি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা না পেয়ে তার স্ত্রী এখন ক্রমান্বয়ে আরও অসুস্থ হচ্ছেন। তিনি বলেন, যে সরকারি হাসপাতালে বসে চিকিৎসক সেবা দিচ্ছেন, সেই হাসপাতালের রিপোর্ট যদি তিনি না দেখেন, তাহলে আমরা কোথায় যাব? আমাদের মত হত দরিদ্রদের কাছে বেসরকারি ডায়াগন্টিক সেন্টার থেকে মেডিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর মত টাকা নেই। তাই বলে কি সরকারি হাসপাতালেও চিকিৎসা সেবা পাব না?

রোগীর সাথে কেন এমন ব্যবহার করা হলো- সেই বিষয়ে ডা. মো. আলাউদ্দিন শিকদারের কাছে জানতে চাইলে বলেন, হাসপাতালে রোগী অনেক দেখী। ওই রোগী যেদিন এমআরআই রিপোর্ট নিয়ে আসেন, সেই দিন অনেক রোগী ছিল। এমআরআই-এর যে রিপোর্ট করতে দেয়া হয়েছিল, খুলনাতে সাধারণত বেশি একটা করানো হয় না। রিপোর্টের ফ্লিমটা তেমন ভালো ছিল না। আর ওনার যে রোগের লক্ষণ, তার সাথে রিপোর্টের ম্যাস করে নাই। আমি তাকে বলেছি রোগের সাথে রিপোর্ট মিলতেছে না। এতটুকুই ঘটনা আরকি।

তবে অন্য চিকিৎসকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, খুলনার যে কোনো বেসরকারি হাসপাতালের তুলনায় খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এমআরআই রিপোর্ট বেশি উন্নত মানের মেশিন দ্বারা করানো হয়। তবে বেসরকারি হাসপাতাল থেকে রিপোর্ট করাতে রোগীকে যে অর্থ প্রদান করতে হয়, তার অর্ধেক কমিশন পান চিকিৎসক। সরকারি হাসপাতাল অল্প খরচে এমআরআই করানো হয় বলে কোনো অর্থের ভাগ চিকিৎসককে দেয়া হয় না।

চিকিৎসকের কাছ থেকে এমন অপমান ও হেনস্তার শিকার হয়ে ওই ব্যক্তি বিস্তারিত ঘটনা উল্লেখ করে খুমেক হাসপাতালের পরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। হাসপাতাল থেকে এই ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে।

গত ৩ জুন তদন্ত কমিটি ওই ব্যক্তিকে তার অভিযোগ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত বলার জন্য খুমেক হাসপতালে হাজির হতে বলেছিল। তবে সেইদিন তাকে নানা রকমের ভোগান্তিতে ফেলে কোনো শুনানি নেননি দায়িত্বপ্রাপ্তরা।

মিন্টু মাতুব্বর বলেন, অভিযোগের ব্যাপারে হাজির হয়ে বক্তব্য দিতে গেলে আমাকে এক ঘণ্টা বসিয়ে রেখে সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. সাইদুল হকের কাছে যেতে বলা হয়। তার কক্ষে গেলে মিটিংয়ে ব্যস্ত থাকার অজুহাত দেখিয়ে পাঠানো হয় আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও) ডা. সুহাস রঞ্জন হালদারের কাছে।

এভাবে তাকে কয়েকবার মিটিংয়ে ব্যস্ত থাকার অজুহাত দেখিয়ে ডা. সাইদুল হক পাঠান ডা. সুহাস রঞ্জন হালদারের কাছে। ডা. সুহাস রঞ্জন হালদারও একই অজুহাতে দেখিয়ে তাকে ডা. সাইদুল হকের কাছে পাঠান। পরর্তীতে তিনি কারো কাছে বক্তব্য না দিতে পেরে পরিচালকের কাছে আরেকটি লিখিত অভিযোগ দিয়ে আসেন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খুমেক হাসপাতালের পরিচালক ডা. গৌতম কুমার পাল বলেন, তদন্ত কমিটির প্রধান ডা. সাইদুল হক শুনানির পরের দিন হজে যাবেন, তাই সেদিন সময় দিতে পারেননি। তিনি হজ থেকে ফিরলে তদন্তের অগ্রগতি হবে। একবার তদন্ত কমিটি গঠন করা হলে, পরিবর্তন করতে ঝামেলা হয়।

রোগীকে হেনস্তা করেন পরিচালক নিজেও

খুমেক হাসপাতাল পরিচালনার জন্য সর্বোচ্চ দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি হলেন পরিচালক। হাসপাতালে অন্যান্য বিষয় নিয়ে তার কাছে রোগী বা চিকিৎসকরা অভিযোগ করেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ব্যবস্থা গ্রহন ও ঊর্ধ্বতন অধিদপ্তর বা মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করতে পারেন। তবে তিনি নিজেও রোগীকে অপমান করে রুম থেকে বের করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

সারা দেশে চিকিৎসকদের সব থেকে বড় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)। গত ২৮ মে পরিচাককের কাছে হেনস্তার শিকার হয়ে মো. মজিবর রহমান নামের এক ব্যক্তি বিএমএ-তে লিখিত অভিযোগ করেছেন। ওই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে খুলনা বিএমএর চিকিৎসক নেতার একটি সাধারণ সভাও করেছেন।

মো. মজিবর রহমানের লিখিত অভিযোগ থেকে জানা যায়, তিনি খুলনা বিএমএ-তে বার্তা বাহক পদে দীর্ঘদিন ধরে চাকরি করেন। গত ২৮ মে খুলনা মেডক্যিাল কলেজ হসাপাতালে এক চিকিৎসকের কাছ থেকে সেবা নিতে যান। তখন সেই চিকিৎসক তাকে কয়েকটি প্যাথলজিক্যাল টেস্ট করার পরামর্শ দেন। পরবর্তীতে তিনি পরিচালকের কার্যালয়ে গিয়ে টেস্টেগুলি বিনামূল্যে করিয়ে দেয়ার অনুরোধ করেন। তবে ওই সময়ে পরিচালক তাকে চরম অপমান করে রুম থেকে রেব করে দেন।

কয়েকজন চিকিৎসকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সরকারি সহায়তায় হত দরিদ্র রোগীদের বিনামূল্য প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা করানোর ক্ষমতা রয়েছে পরিচালকের। তবে বর্তমান পরিচালক হত দরিদ্র রোগীদের সেই সেবা দিতে নারাজ রয়েছেন। এর মূলে রয়েছে বেসরকারি ডায়াগস্টিকের প্যাথলজিক্যাল ব্যবসা ও সিন্ডিকেট।

এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খুলনা বিএমএর সভাপতি ডা. শেখ বাহারুল আলম বলেন, অভিযোগ পাওয়ার পরে আমরা ইমার্জেন্সি মিটিং করেছি। তাতে পরিচালকের কাছে বক্তব্য চাওয়া হয়, সেই সাথে উপস্থিত ব্যক্তিদেরও বক্তব্য নিয়েছি। একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল আরকি। হয়তো পরিচালকের কথা শুনে তিনি মনে করেছেন অমর্যাদা হয়েছে। বিষয়টি আমরা মিটিয়ে দিয়েছি।

তবে ওই দিন কী ঘটেছিল তা জানতে চাইলে খুমেক হাসপাতালের পরিচালক ডা. গৌতম কুমার পাল বলেন, তা আমার মনে নেই। এত কিছু মনে রাখতে গেলে তো আমার মাথায় টিউমার হয়ে যাবে। হয়তো ওই ব্যক্তির সমস্যা আছে।


আরো সংবাদ পড়ুন...
এক ক্লিকে বিভাগের খবর