১৯৪৭ সালের দেশভাগের বলি এক ভাগ্যহত সংগ্রামী মানুষের নাম রবি খান পাঙাল। তার বাড়ি ব্রিটিশ ভারতের আসাম প্রদেশের সিলেট জেলায়। গ্রামের নাম গুলের হাওর, তৎকালীন মৌলভীবাজার মহকুমার কমলগঞ্জ থানায়। জন্ম তার মণিপুরি মুসলিম বা পাঙাল জনজাতি পরিবারে। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় অতিক্রম করে দূরবর্তী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় লেখা পড়ার ইতি টানেন তিনি। ছোট কাল থেকেই তার ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন ছিল। বাড়ি থেকে মাত্র নয় কি দশ কি.মি. দূরে ত্রিপুরা রাজ্যের কমলপুর মহকুমা শহর। অথচ বাড়ি থেকে নিজের মহকুমা শহরের দূরত্ব ৪০ কি.মি. এরও বেশি। তিনি সিদ্ধান্ত নেন ত্রিপুরার কমলপুর শহরে যাবে এবং সেখানে ব্যবসা শিখবে। কিন্তু তার বাবা মাতো তাকে যেতে দিবে না। যেমন চিন্তা তেমন কাজ, একদিন কাউকে কিছু না বলে তিনি হঠাৎ বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যান।
তিনি সারা দিন কমলপুর শহর ঘুরে ঘুরে দেখেন, তার বেশী খেয়াল ছিল দোকানগুলোর বেচাকিনার দিকে। সন্ধ্যায় গিয়ে উঠেন পাশের বড়বাড়ি গ্রামে, এক আত্মীয়ের বাড়িতে। উল্লেখ্য যে, ত্রিপুরার কমলপুর মহকুমায় পাঁচ, ছয়টি পাঙাল গ্রাম বিদ্যমান রয়েছে, গ্রামগুলোতে রবি খানের অনেক আত্মীয় স্বজনের বসবাস। পরের দিন সকালে সেখানকার তার এক আত্মীয়কে সাথে নিয়ে তিনি কমলপুর শহরে আবার যান। আত্মীয়ের সহযোগিতায় সেখানকার এক মারওয়ারীর দোকানে চাকুরি নেন তিনি।
রবি খানের কমলপুরে চাকুরি নেওয়ার খবরটি ক্রমে ক্রমে চাউর হয়ে যায় তার এলাকাতেও। পরে তার বাবা মাও শুনতে পাই বিষয়টি, একমাত্র সন্তানের অদম্য ইচ্ছাকে বাঁধা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তারা। রবি খানও ছুটি নিয়ে বাড়িতে এসে দেখা করে যান বাবা মায়ের সাথে। এভাবে কেটে যায় একটি বছর।
রবি খান সিদ্ধান্ত নেন স্বাধীন ভাবে ব্যবসা করবে। তিনি তার বাবা মাকে বিষয়টি অবহিত করেন। নিম্নবিত্ত পরিবার, হাতে নগদ টাকা কড়িও খুব একটা নেই।ভাবলো অন্ধের কিবা দিন কিবা রাত। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর উপর ভরসা করে সিদ্ধান্ত নিল , সামান্য ফসলি জমি যা আছে তা বিক্রি করে দেবে। কথা যেমন কাজও তেমন। যথা সময়ে রবির বাবা জমি বিক্রির টাকা তুলে দেন ছেলের হাতে।টাকা পেয়ে রবি খান ছোট একটি দোকান ভাড়া নেন। শুরু করেন সুতা ও কাপড়ের দোকান।
খান সাহেব ছিলেন অনিন্দ্য সুন্দর সৌম্য কান্তি পুরুষ, তার অমায়িক ব্যবহার ক্রেতাকে সহজেই আকর্ষণ করতে পারতো। কথায় বলে “অমায়িক ব্যবহার যার মুখে আছে, পৃথিবীও ঋণী হয় ঠিক তার কাছে।” তদুপরি কমলপুরের বেশ কয়েকটি গ্রাম ছিল তার সমগোত্রীয় পাঙাল সম্প্রদায়ের। তাছাড়াও এলাকাটিতে অনেক ত্রিপুরা, মৈতৈ ও বিষ্ণুপ্রিয়া উপজাতিদের বসবাস, এরা সবায় বাড়িতে কাপড় বুনে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে এদের পছন্দের সুতা মহাজনে পরিনত হন রবি খান সাহেব। দিন দিন তার ব্যাবসার পরিধি প্রসারিত হতে থাকে। আয়, ইনকামও বৃদ্ধি পায়। কমলপুরের একজন ভাল ব্যবসায়ী হিসেব তার সুনাম, সুখ্যাতি দিন দিন বাড়তে লাগলো। এককথায় তার নিরলস অধ্যাবসায়ের ফলে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীতে পরিনত হন।
তারপর এলো দেশ বিভাগের সময়। উত্তাল উপমহাদেশব্যাপী। ১৯৪৭ সালের ২০ শে জুন, বঙ্গীয় আইন পরিষদের বঙ্গ প্রদেশের ভবিষ্যত নির্ধারণের জন্য মিলিত হয় যেখানে ভারত বা পাকিস্তানের মধ্যে সংযুক্ত বাংলা বা পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিমবঙ্গে বিভক্ত করে যথাক্রমে বাঙালি মুসলমান এবং বাঙালি হিন্দুদের আবাসস্থল হিসাবে গঠনের প্রস্তাব হয়। প্রাথমিকভাবে অবিভক্ত বাংলার যৌথ অধিবেশনে, পরিষদ ১২০-৯০ দ্বারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে যদি বঙ্গ পাকিস্তানের নতুন গণপরিষদে যোগ দেয় তবে এটি ঐক্যবদ্ধ বা অবিভক্ত থাকবে। পরে, পশ্চিমবঙ্গের আইনপ্রণেতাদের একটি পৃথক বৈঠকে ৫৮-২১ ভোটে সিদ্ধান্ত নেয় যে প্রদেশটি বিভক্ত করা উচিত এবং পশ্চিমবঙ্গকে ভারতের বিদ্যমান গণপরিষদে যোগদান করা উচিত। পূর্ব বাংলার আইনপ্রণেতাদের আরেকটি পৃথক সভায় ১০৬-৩৫ ভোটে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, প্রদেশটি বিভক্ত করা উচিত নয় এবং ১০৭-৩৪ ভোটে আরেকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, দেশভাগের ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলা পাকিস্তানে যোগ দেবে।
এদিকে সিদ্ধান্ত হলো আসাম ভারত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হবে তবে সিলেটের ভারত বা পাকিস্তান ভূক্তির ব্যাপারে পাগণভোট অনুস্থিত হবে। রবি খানের ধারণা ছিল গণভোটে সিলেট পাকিস্তানেই যোগ দেবে, আর তখন দেশীয় রাজ্য হিসেবে ত্রিপুরার পাকিস্থানে যোগ দেওয়া ছাড়া কোন গত্যন্তর থাকবেনা। তাই সে বাড়িতে গিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য জোড় প্রচারনা চালায়। সিলেটের শাহী ইদগায়ে মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ আসবে শুনে সে সিলেটেও গিয়েছিলেন। সেখান থেকে সে করিমগঞ্জে যান, সেখানে সে তৎকালীন তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্বাচনী প্রচারণা করতে দেখেছেন। সেখানে রবি খান পাঙালও শ্লোগান দিয়েছে “মুসলীম লীগের মার্কা কী- কুড়াল ছাড়া আর কী, পাকিস্তান জিন্দাবাদ- লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান, কায়দে আজম, কায়দে আজম- জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ” ইত্যাদি।
রবি খানের প্রচেষ্টা ব্যার্থ হয়নি। ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ জুলাই অনুষ্ঠিত গণভোটের রায় মোতাবেক সিলেট পাকিস্তানে যোগ দেয়। সিলেটের সর্বত্র পাকিস্তানের পতাকাও উত্তোলিত হয়, কিন্তু বাদসাধে র্যাডক্লিফ রোয়েদাদ। র্যাডক্লিফ লাইন করিমগঞ্জের সাড়ে তিন থানাকে ভারতের আসামে অন্তর্ভুক্ত করে। এরই ধারাবাহিকতায় “১৯৪৯ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর, ত্রিপুরার ভারতে অন্তর্ভুক্তি চুক্তি মোতাবেক ১৫ অক্টোবর ১৯৪৯ থেকে ভারতীয় অধিরাজ্যে অংশীভূত হয়ে যায়।
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস ত্রিপুরার ভারতভূক্তিতে তার বাড়ি গিয়ে পড়লো পাকিস্তানে আর ব্যবসাক্ষেত্র গিয়ে পড়লো ভারতে। রবি খানের কাছে বিষয়টি যেন ‘বিনা মেঘে বজ্রপাত’। কি আর করা, গতস্য শোচনা নাস্তি’। রবি নিজের মনকে শক্ত করে নিল। ভাবলো প্রয়োজনে নিজের জন্মভূমিকে ত্যাগ করে ত্রিপুরাতেই বসতি গড়বেন। রাজনীতির চিন্তা ছেড়ে দিয়ে ব্যবসাতেই পুনঃ মনোযোগী হলেন।
কথায় বলে পোড়া কপাল, জোড়া লাগেনা, ভারতব্যাপী সংগঠিত জাতিগত দাঙ্গার ঢেউ হঠাৎ ত্রিপুরাতেও এসে লাগলো। কোন এক রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনে কমলপুরের কিছু সংখ্যক হিন্দু জনগোষ্ঠী হামলে পড়লো সেখানকার মুসলমানদের উপর। বাদ গেল না কমলপুর শহরটিও, মূহুর্তেই লুটেপুটে ছারখার রবির দোকানটিও।
প্রতিহিংসার বারুদ থেকে উৎপন্ন আগুনে দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো কমলপুরের মুসলিম বাড়িগুলো। বহু মুসলমান উদ্ভাস্তু হলো। সিমান্ত পাড়ি দিয়ে আশ্রয় নিলো পূর্ব পাকিস্তানে। রবি খানও সেই কাফেলার সহযাত্রী। কমলপুরের সেই প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী আজ নিঃস্ব-রিক্ত। কিছুদিন পর পরিস্থিতি শান্ত হলে অনেক উদ্ভাস্তু ফিরে গেলেও রবি খান আর ফিরে যায়নি তার প্রাণের কমলপুরে, থেকে যান জন্মভূমে।
লেখক ও গবেষক, মো. আব্দুস সামাদ, কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার