আমার জন্ম বাংলার এক অজপাড়াগাঁয়ে। ছোটবেলায় আমার দিন শুরু হতো কাকডাকা ভোরে। মা রান্নাঘরে ভাত বসাতেন, আমি ঘুমচোখে উঠেই ছুটে যেতাম পুকুরপাড়ে বা নদীর তীরে। কাদা-মাখা মেঠো পথ ধরে হেঁটে যেতে যেতে সাইকেলের টুং টাং আওয়াজ আর কৃষকদের হালের বলদ চড়ানোর হৈ হৈ শব্দে গ্রামের সকালটা জেগে উঠত পূর্বাকাশটা রঙিন করে ।
খানিক পরে প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে দেখতে বাড়ি ফিরে আসতাম। শীত কালে নদীর পাড়ে পলি মাটিতে টপাটপ করে বেড়ে উঠা রবি শস্য দেখতে ভারি সুন্দর। বাড়িতে আসার পর মা আমার হাতে বাবার নাস্তা ধরিয়ে দিতেন। আমি নাস্তা নিয়ে মাঠে বাবার কাছে যেতাম। বাবা আমাকে দেখে কাজ বন্ধ করে এগিয়ে আসতেন। আমার হাত থেকে নাস্তা নিয়ে পরম তৃপ্তিতে খেতেন।
গ্রামের নাম নবীনগর। ছোট, সবুজ, নিঃশব্দ একটা জায়গা। এখানেই আমার জন্ম স্থান, এখানেই শিকড়। বড় হতে হতে স্বপ্ন দেখতাম—শহরে যাবো, বড় চাকরি করব, গাড়ি কিনব, বাবা-মাকে গর্বিত করব।
বাবা ছিলেন একজন কৃষক। মাটির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল মায়ের মতো। তাঁর কপালে মাটি লেগে থাকত, আর চোখে থাকত অদ্ভুত এক শান্তি। আমি বুঝতাম না তখন, সেই মাটিই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখে।
সময় গড়ালো। আমি গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে এলাম। পড়াশোনা, চাকরি, ব্যস্ততা—সব পেরিয়ে একদিন সত্যিই গাড়ি কিনলাম, অফিসের বস হলাম। কিন্তু মনের কোথাও একটানা একটা শূন্যতা জমতে থাকল।
এবার ঈদের ছুটিতে হঠাৎই সিদ্ধান্ত নিলাম—গ্রামে যাবো, যাবো আমার জন্মভূমিতে। ঈদের দুদিন আগে কমলাপুর থেকে ট্রেনে উঠলাম। টানা চার ঘন্টা ভ্রমনের পর ট্রেন থেকে নামলাম। নামার পর যেন একটা আলাদা ঘ্রাণ পেলাম। মাটির, ধুলোর, স্মৃতির ঘ্রাণ।
নবীনগর এখনও আগের মতোই আছে, যদিও মানুষগুলো বদলে গেছে। রাস্তা ঘাট পাকা হয়েছে। বাবা আর নেই, তাঁর প্রিয় খেত এখন পরের দখলে। মা অনেকটাই চুপচাপ, শুধু আমাকে দেখে চোখে জল আসলো। বন্ধুরা কেউ চায়ের দোকানে বসে, কেউ বাজারে ছোট দোকান দিয়েছে আবার কেউ সবজী বিক্রি করে—তবু তারা এখনও সেই আগের মতোই হাসে। দারিদ্রতা তাদের সেই হাসি কেড়ে নিতে পারেনি।
এক রাতে, খোলা আকাশের নিচে ধান ক্ষেতের পাশে দাঁড়িয়ে মনে হলো, আমি যেন নতুন করে শ্বাস নিচ্ছি। এই মাটি, এই বাতাস, এই মানুষগুলো—তারা আমাকে শেখায় কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা, ফিরে আসার মানে।
পরদিন মা বললেন, “তুই আবার চলে যাবি বুঝি?”
আমি একটু চুপ করে থাকলাম তার পর বললাম, “এইবার যেতে ইচ্ছা করছে না মা।”
লেখক ও গবেষক, মো. আব্দুস সামাদ, কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার