বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই ২০২৫, ১১:১৯ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম :
সংবাদ শিরোনাম :

শানারাই-এর জীবন গড়া

হাজী মো. আব্দুস সামাদ / ২২৬ বার দেখা হয়েছে
প্রকাশিত : বৃহস্পতিবার, ১ মে, ২০২৫

আমি বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীভুক্ত মণিপুরি মুসলমান সমাজের এক নারী—অসহায়, তবে আশাবাদী। আমার নাম শানারাই বিবি। ‘শানারাই’ শব্দের অর্থ গাঁদা ফুল। জন্মের পর মা-বাবা ভালোবেসে মণিপুরি ভাষায় এই নাম রেখেছিলেন। এখন আর এমন নাম খুব একটা শোনা যায় না। ইসলামি সংস্কৃতির প্রভাব বেড়ে যাওয়ায় অধিকাংশ পরিবার আরবি-ফারসি নাম বেছে নিচ্ছে।

আমার জন্ম মৌলভীবাজার জেলার নিভৃত এক গ্রামে—জলসিঁড়ি গাঁও। এটি আমার মায়ের পৈতৃক নিবাস। বাবার বাড়ি ভারতের আসাম রাজ্যের কাছাড় জেলার বাঁশকান্দি গ্রামে। পাকিস্তান আমলে তিনি বেড়াতে এসে বাংলাদেশেই স্থায়ীভাবে থেকে যান। এখানেই বিয়ে করেন আমার মা-কে, এখানেই গড়ে ওঠে আমাদের ছোট্ট সংসার।

আমি তখন সবে তিন বছরের। একদিন বাবা হঠাৎ নিখোঁজ হন। আর কখনও ফিরে আসেননি। হয়তো সংসারের দুঃখ-অভাব তাঁকে ভারাক্রান্ত করেছিল। কিন্তু আমাদের এভাবে ফেলে চলে যাওয়া—তা কিছুতেই ক্ষমা করা যায় না।

বাবার চলে যাওয়ার পর মা ভেঙে পড়েন মানসিকভাবে। সংসার চালানো, সমাজের কটুকথা সহ্য করা, একা নারী হয়ে সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়া—সব মিলিয়ে তাঁর জীবন হয়ে ওঠে এক নীরব যুদ্ধ। বড় মামা নানা জায়গায়, এমনকি কাছাড়েও খোঁজ নিয়েছিলেন, কিন্তু বাবার সন্ধান আর মেলেনি।

আমার বয়স তখন স্কুলে যাওয়ার উপযুক্ত। সমবয়সীরা স্কুলে যাচ্ছে, কিন্তু আমার মা এই নিয়ে একবারও মুখ খোলেননি। হয়তো তিনি আর কিছুতেই মন দিতে পারছিলেন না। সেই সময় বড় মামাই এগিয়ে এলেন। তিনিই আমাকে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন জলসিড়ি প্রাইমারি স্কুলে—যেটা তখন গ্রামের শিক্ষার একমাত্র আলো।

প্রথম দিন স্কুলে গিয়ে বুঝলাম, আমি অন্যদের চেয়ে আলাদা। আমাদের ভাষা, পোশাক, উচ্চারণ—সবকিছুতেই একটা ভিন্নতা ছিল। সহপাঠীরা মাঝেমধ্যেই ঠাট্টা করত। আমার নাম নিয়েও হাসাহাসি হত—“সানারাই? এমন নামও হয় নাকি?” তারা জানত না, এই নামের ভেতরে রয়েছে ভালোবাসা, সংস্কৃতি আর আত্মপরিচয়ের গর্ব।

তবু আমি দমে যাইনি। মা একদিন বলেছিলেন, “তুই যদি লেখাপড়া শিখিস, তোর মতো মেয়েদের জীবন হয়তো বদলাতে পারবি।” এই বাক্যটাই ছিল আমার প্রেরণা।

সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল বই কেনা। নতুন বইয়ের গন্ধ আমার খুব পছন্দ হলেও সেটা কদাচিৎ পাওয়া যেত। পুরনো, ছেঁড়া কিংবা কারো দান করা বই দিয়েই চলত পড়ালেখা।

চতুর্থ শ্রেণিতে আমি স্কুলে প্রথম হই। তখন শিক্ষকরা আমাকে আলাদা নজরে দেখতে শুরু করেন। ক্লাস শেষে বাড়তি পড়া দিতেন। আমিও বুঝে গিয়েছিলাম—এই শিক্ষাই একদিন আমার মায়ের মুখে হাসি ফিরিয়ে আনতে পারে।

প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ভর্তি হই ধানসিঁড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ে। প্রতিদিন তিন কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে যেতাম। রোদ, বৃষ্টি, কাঁদা—সবকিছুর মাঝেই আমার পায়ে থামার শক্তি ছিল না। কারণ আমি জানতাম, প্রতিটি পদক্ষেপই ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নেওয়া একেকটা ধাপ।

মাধ্যমিকে জিপিএ-৫ পাই। আমার নাম প্রথমবারের মতো পত্রিকায় ছাপা হয়। সেই দিন মায়ের চোখেমুখে যে গর্ব ছিল—সে দৃশ্য আজও ভোলা যায় না। মনে হয়েছিল, হয়তো এবার তিনি সত্যিই বিশ্বাস করেছেন, তাঁর মেয়ে কিছু একটা করতে পারবে।

এরপর কলেজে ভর্তি হই। শুরু হয় আরেক পর্বের সংগ্রাম—আর্থিক সংকট, সমাজের বিদ্রূপ, নিজের সম্প্রদায়ের রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি—সবকিছুর বিরুদ্ধে এক টানা লড়াই। অনেকেই বলত, “মেয়েমানুষ এতদূর পড়ে কী হবে?” কিন্তু আমি থামিনি। আমি নিজেকে বিশ্বাস করতাম।

আজ আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এখনো অনেক পথ বাকি, অনেক যুদ্ধ বাকি। কিন্তু আমি জানি, আমার নাম যেমন ‘সানারাই’—একটি গাঁদা ফুল, আমিও তেমনি প্রতিকূলতার মাঝেও ফুটে উঠতে পারি।

আমার গল্প শুধু আমার একার নয়। আমার মতো আরও অনেক মণিপুরি মুসলমান মেয়ের গল্প এটি। আমরা চাই—আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, আর আত্মপরিচয় রক্ষা করে এগিয়ে যেতে। কারণ আমরা শুধু অবলা নারী নই, আমরা সম্ভাবনার প্রতীক।

অধ্যায় ৩: সম্ভাবনার প্রতীক সানারাই – পাঠকের প্রতি বার্তা

আমার গল্প, সানারাইয়ের গল্প, শুধু আমার একার নয়—এটা আমাদের মতো হাজারো মণিপুরি মুসলমান মেয়ের গল্প, যারা সমতলের গ্রামে জন্ম নেয়, বঞ্চনার পাহাড় ডিঙিয়ে বড় হয়, এবং আত্মপরিচয় ধরে রেখেই এগিয়ে যেতে চায়।

আমরা অনেকে হয়তো জন্মের পর থেকেই জীবনের সাথে এক অসম লড়াইয়ে নেমে পড়ি। কেউ জন্মায় বাবাহীন সংসারে, কেউ শিক্ষার সুযোগ পায় না, কেউবা সমাজের চোখ রাঙানিতে হারিয়ে যায়। কিন্তু তবুও, যারা হাল ছাড়ে না, তাদের মাঝেই লুকিয়ে থাকে এক সম্ভাবনার আলো।

আমি চাই—আমার জাতিসত্তা, আমার ভাষা, আমার সংস্কৃতি নিয়ে আমি যেন গর্ব করতে পারি। আমি চাই—আমার আগামী প্রজন্মের মেয়েরাও একদিন বুক উঁচু করে বলতে পারে, “আমি মণিপুরি মুসলমান, আমি নারী, আমি সংগ্রামী, এবং আমি সফল।”

এই বই যদি কোনো এক মেয়ে শিশুর হাতে পৌঁছায়, যার চোখে স্বপ্ন আছে কিন্তু পথে বাধা, সে যেন বুঝতে পারে—প্রতিটি প্রতিকূলতা একেকটি ধাপ মাত্র, যা তাকে আরো দৃঢ়, আরো আলোকিত করে।

আমার মায়ের মতো আরও মায়েরা যদি মেয়েদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে বলেন, তাহলে অনেক সানারাই আজ শুধু গল্প নয়, ইতিহাস হবে।

সানারাই শুধু এক গাঁদা ফুল নয়, সে প্রতিকূলতার মাঝে ফুটে ওঠা এক সংগ্রামী সৌন্দর্যের নাম।

লেখক ও গবেষক, মো. আব্দুস সামাদ, কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার


আরো সংবাদ পড়ুন...
এক ক্লিকে বিভাগের খবর