আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দিনগুলো ছিল মিশ্র অভিজ্ঞতায় ভরা—কখনো রোদ, কখনো ছায়া।
পঞ্চম শ্রেণিতে উঠতেই চারপাশে একটা চাপা প্রতিযোগিতার আবহ তৈরি হলো। শিক্ষকেরা বলতেন, “বৃত্তি পেতে হবে, নাম করতে হবে।”
আমার মা, যদিও তেমন বোঝার মতো অবস্থায় ছিলেন না, তবুও প্রতিদিন খেয়ে না খেয়ে বলতেন, “তোর লেখাপড়ার খরচ যোগানোর জন্য যদি আমাকে দুবেলা না খেয়ে কাজ করতে হয়, তবুও করবো। তুই শুধু থেমে যাস না।”
মায়ের এই অদৃশ্য শক্তি আমার রক্তে ঢুকে গিয়েছিল।
ভোরের কুয়াশা ভেদ করে স্কুলে যাওয়া, হাতে পুরনো বই, মায়ের বোনা মফলার গলায় পেঁচানো—এই ছিল আমার শৈশবের ছবি।
স্কুলের অনেক শিক্ষক আমার ওপর বিশেষ নজর দিতেন। কিন্তু কিছু সহপাঠী ছিল, যারা আমাদের পাঙাল পরিচয় নিয়ে বিদ্রুপ করতো। তারা বলতো
“ওরা তো আলাদা জাতের – খাই বাঙাল (খা-ই-বাঙাল)। এরা কখনো বড় কিছু হতে পারবে না,”—এই রকম কথা শুনতাম প্রায়ই। কখনো ভীষণ কষ্ট পেতাম। কিন্তু মা বলতেন, “ঝড় যদি আসে, মাথা নিচু করিস না, পা শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকিস। ঝড় নিজেই হার মানবে।”
মা তখন আমাদের সংসার চালাতে হ্যান্ডলুমে দিনরাত বুনতেন—শাড়ি, ওড়না, মাফলার, গামছা। খটখট আওয়াজে ভরে উঠত আমাদের ছোট্ট কুঁড়েঘর। সেই আওয়াজ যেন আমার জন্য ছিল জীবনের গান—সংগ্রামের সুর।
বই কেনার টাকার জন্য আমি পুরনো বই প্রতিবেশীদের নিকট থেকে চেয়ে নিয়ে বিক্রি করতাম, কখনো হাতের কাজ শিখতাম। বন্ধুরা নতুন বই কিনলে, আমি তাদের পুরনো বই চেয়ে নিতাম—কোনো লজ্জা ছিল না, বরং ছিল অদম্য ইচ্ছে। তবুও, সবকিছুর মধ্যে ছোট ছোট আনন্দও ছিল।
কখনো মায়াবী সন্ধ্যায় নদীর পাড়ে বসে বই পড়তাম। কখনো রাঙা সূর্যাস্ত দেখে মনে হতো, একদিন আমি এই গ্রামের সীমানা পেরিয়ে আরও বড় কোনো দিগন্তে পৌঁছাবো।
ঠিক তখনই গ্রামের এক শিক্ষক, সাহাজ স্যার- সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসেন। তিনি প্রায়ই বাড়িতে এসে অংক আর ইংরেজী পড়িয়ে যেতেন। এভাবে দিন গড়িয়ে বছর পার হয়ে গেল৷ যথা সময়ে স্কুল ফাইনেল ও বৃত্তি পরিক্ষা অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। কিছু দিন পর স্কুল ফাইনেল পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলো। আমি ক্লাশে প্রথম হলাম।
কিন্তু বৃত্তি পরীক্ষায় আমি হোচৎ খেলাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম আমি বৃত্তি পাবো। শিক্ষকরাও আশ্বাস দিয়েছিলেন।
কিন্তু ফলাফল বের হতেই দেখি, আমার নাম নেই।
সেই দিনটা আমার জীবনের প্রথম ‘ভেঙে পড়া’ দিন।
মা এসে কাঁধে হাত রাখলেন, বললেন, “মাটিতে পড়ে থাকিস না, মাটির শক্তি ধর। মেয়ে হয়ে জন্মেছি—লড়াই ছাড়া কিছু জুটবে না আমাদের।”
আমিও ভাবলাম এভাবে মন খারাপ করে বসে থাকলে চলবে না। উঠে দাঁড়াতে হবে। তারপরের দিন থেকে আমি আবার বই খুলে বসি। আবার নতুন স্বপ্ন আঁকি—আরও বড় হওয়ার, আরও দূরে যাওয়ার।
তখনই প্রথম মনে হয়—আমি শুধু আমার জন্য না, আমার মায়ের জন্য, আমার জাতির জন্যও কিছু করতে চাই।
সেই সময় থেকেই মনে মনে ঠিক করেছিলাম—আমার জীবন এখানেই থেমে যাবে না। আমি শুধু সানারৈয়ের না, আমি হবো হাজার সানারৈয়ের স্বপ্নের প্রতিনিধি।
আর সেই স্বপ্ন আমাকে টেনে নেবে—অন্য এক পথে, অন্য এক যাত্রায়।
পঞ্চম শ্রেণি শেষ হতেই আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম হাই স্কুলে ভর্তি হওয়ার। শিক্ষকরা বলতেন, “তুই হলে স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করবি।”
মা কিছুটা বিমর্ষ হয়ে বলতেন, “হাই স্কুলে গেলে তো খরচ আরও বাড়বে মা… কিন্তু আমি চেষ্টা করবো।”
আমিও ভাবতাম, একদিন হয়তো সাদা জামা পরে, ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বড় স্কুলে হাঁটবো।
কিন্তু বাস্তবতা কঠিন ছিল।
বৃত্তি পরীক্ষায় না পেয়ে স্কুল থেকে কোনো প্রকার সহায়তা পাওয়া গেল না। মা দিনরাত হ্যান্ডলুমে বুনেও খরচ জোগাতে পারছিলেন না। বড় মামা চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু আমাদের এলাকায় উচ্চবিদ্যালয়ের দূরত্ব আর
প্রয়োজনীয় খরচ—সব মিলিয়ে ভর্তি সম্ভব হলো না।
সেই দিনগুলো আমার জীবনের সবচেয়ে নীরব দিন ছিল।
যেন সব বন্ধ হয়ে গেছে।
বাড়ির উঠোনে বসে থাকতাম বই হাতে, কিন্তু মন থাকতো অন্যখানে—স্কুলের ঘণ্টার শব্দ, সহপাঠীদের হাসিমুখ, নতুন ক্লাসের কল্পনা।
পাড়া-পড়শিরা কেউ কেউ বলতো, “মেয়ে মানুষ, হাই স্কুলে গিয়ে কী হবে? লেখাপড়া তো শেষ পর্যন্ত চুলার ধোঁয়া!”
আমি মুখে কিছু বলতাম না, কিন্তু ভেতরে জ্বলে উঠতাম।
তবুও হাল ছাড়িনি।
পুরনো বই-খাতা দিয়ে নিজেই পড়া চালিয়ে যেতে থাকি। পাশের স্কুলের এক আপা, যিনি আমাদের বাড়ির কাছেই থাকতেন, তিনি কখনো কখনো আমাকে পড়িয়ে দিতেন।
আমার মা বলতেন, “তোকে যদি স্কুলে ভর্তি না করাতে পারি, তবে ঘরেই স্কুল বানাবো।”
এইভাবেই আমি আমার অদৃশ্য স্কুল শুরু করি।
প্রতিদিন নিয়ম করে পড়তাম, লিখতাম, মুখস্থ করতাম। যেনো কেউ আমাকে দেখছে, শুনছে—আমি যেন নিজেকেই শেখাচ্ছি।
মায়ের চোখে আবার একটু আলো ফুটতে থাকে।
আমি তখন বুঝে যাই—স্কুল শুধু একটা ভবন না, শিক্ষাও কেবল পরীক্ষার খাতা না।
শিক্ষা হচ্ছে—যেখানে মন চায় কিছু জানত, আর মন জিতে নেই সেই আকুতি।
লেখক ও গবেষক, মো. আব্দুস সামাদ, কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার