শিক্ষা উপবৃত্তির টাকা দেওয়ার নাম করে বিভিন্ন ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রতারণা, অর্থ আত্মসাতে জড়িত মূলহোতাসহ ৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। গতকাল সোমবার কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাব-৫ এর অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মুনীম ফেরদৌস।
তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও গোয়েন্দা কার্যক্রমের ভিত্তিতে ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, জামালপুর, কুমিল্লা ও ফরিদপুরসহ বিভিন্ন স্থানে যৌথ অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে র্যারের ৬টি ব্যাটালিয়ন টিম।
গ্রেপ্তাররা হলেন- মূলহোতা জাকির হোসেন হাওলাদার (৪৭), অন্যতম মূলহোতা মো. বাপ্পি মোল্লা (২০), মো. উসমান গনি মোল্লা (৩৩), শামীম হোসেন (২৯), মোহাম্মদ জিহাদ (৩৪), কাজী সাদ্দাম হোসেন ওরফে আমির হামজা (২৬), মো. আহাদ গাজী (২৪) ও মো. মোস্তাফিজুর রহমান ওরফে জয় (২৬)।
র্যাব বলছে, সারা দেশে প্রতারক চক্রটির দুই হাজারের বেশি এজেন্ট বা সদস্য রয়েছে। শেয়ার বাজারের মতো দরকষাকষি করে তাদের প্রতি হাজারে ৩০-৪০ টাকা কমিশনে প্রতারণার কাজ দেওয়া হয়। এজেন্ট হতে হলে দিতে হয় অগ্রিম ৫০ হাজার টাকা।
চক্রটির সঙ্গে জড়িত একটি মোবাইল অপারেটর কোম্পানির সিম কার্ড বিক্রেতারাও। তারা অন্যের নামে রেজিস্ট্রেশনকৃত সিম বা বিক্রি করা সিম সংগ্রহ করে প্রতারণামূলক কাজে ব্যবহার করে মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট খোলে। সাধারণ মানুষের সংগৃহীত এনআইডি ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে রেজিস্ট্রেশনকৃত সিম ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকায় সংগ্রহ করে প্রতারণার কাজে ব্যবহার করে আসছে এই চক্রটি। প্রতারণার টাকা মূল চক্রের সদস্যের মধ্যে বণ্টন করা হয়। কমিশন ও কাজের খরচ বাবদ এজেন্টদের দেওয়া হয় নির্ধারিত টাকা।
র্যাব কর্মকর্তা বলেন, গত ২৪ মার্চ সকালে রাজশাহীর বোয়ালিয়া মডেল থানার শালবাগান রাজশাহীর বিএনসিসি অফিসে অবস্থানকালে এক ভুক্তভোগীর ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে অজ্ঞাতনামা মোবাইল নম্বর থেকে মেয়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টের শাখায় কর্মরত মিজানুর রহমান বলে পরিচয় দিয়ে তার মেয়ের এসএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়ায় শিক্ষা উপবৃত্তির ২২ হাজার ৫০০ টাকা এসেছে বলে জানায়। ওই টাকা বাদীর অ্যাকাউন্টে চলে যাবে মর্মে একটি ব্যাংকের এটিএম কার্ডের ১৬ ডিজিটের নম্বর দিতে বললে তিনি তার নম্বর দিলে একটি ওটিপি যাবে বলে জানায়। পরে বাদী মোবাইল মেসেজে দেখতে পান তার অ্যাকাউন্ট থেকে চার বারে এক লাখ ৫০ হাজার ৫০০ টাকা নিয়ে গেছে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা।
ওই ঘটনায় বাদী অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে আরএমপির বোয়ালিয়া মডেল থানায় একটি মামলা করেন। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা জড়িতদের গ্রেপ্তারে র্যাব-৫, অধিযাচনপত্র প্রদান করলে জড়িতদের গ্রেপ্তারে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায় র্যাব।
এরই ধারাবাহিকতায় র্যাব-৫-এর একটি দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শিক্ষা উপবৃত্তি টাকা দেওয়ার নাম করে ক্রেডিট কার্ড ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রতারণার কাজে জড়িত শামীম হোসেনকে রাজশাহী জেলার রাজপাড়া এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে।
জিজ্ঞাসাবাদে শামীম জানান, তিনি শুধু মাঠ পর্যায়ে মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উত্তোলন করে বিভিন্ন ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে পাঠাতেন। তার দেয়া তথ্যে ঢাকার আশুলিয়া এলাকায় একটি বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করে বিভিন্ন কোম্পানির সিম কার্ডসহ বেশ কয়েকটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করে র্যাব। এরপর একে একে জাকিরসহ বাকিদের গ্রেপ্তার করা হয়।
তাদের কাছ থেকে ২৩টি মোবাইল সেট, ৩১০টি সিম কার্ড, নগদ ৩ লাখ ১ হাজার ২৭০ টাকা ও নয়টি ব্যাংক লেনদেন স্লিপ উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত প্রত্যেকটি সিম কার্ডে বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অ্যাকাউন্ট রয়েছে। তারা বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও সরকারি অফিস থেকে শিক্ষা উপবৃত্তি টাকা দেওয়ার তথ্য সংগ্রহ করেন। পরে ওয়েলকাম/হ্যালো গ্রুপের কলিং সেন্টারে শেয়ার করেন ৷ এরপর জাকির হোসেনের দুই ছেলে মানিক ও হীরা ফোন দিয়ে নম্বর নেন। পরে ভিকটিমের সঙ্গে কথা বলে বিশ্বস্ততা অর্জন করে ওটিপি নিয়ে টাকা আত্মসাৎ করেন।
এক প্রশ্নের জবাবে র্যাব-৫ অধিনায়ক বলেন, ওয়েলকাম/হ্যালো গ্রুপের রয়েছে সারাদেশে দুই হাজারের বেশি এজেন্ট। এজেন্ট হতে হলে অগ্রিম ৫০ হাজার টাকা দিতে হয়। পরে মোবাইলে তাদের নামে অ্যাকাউন্ট হয়। ইতোমধ্যে তদন্তে ১ হাজার ৮৬১টি মোবাইল নাম্বার শনাক্ত করা হয়েছে, যেগুলোতে টাকা লেনদেন ও যোগাযোগ হয়েছে।
তিনি বলেন, চক্রের সদস্যরা এক জায়গায় বেশি দিন থাকেন না। মূল শহর থেকে ১৫-১৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করেন। আর হাজারে ৩০-৪০ টাকা কমিশনে এজেন্ট নিয়োগ করা হয়। এজেন্টের এন্ট্রিকৃত মোবাইল অ্যাকাউন্টে টাকা যায়। তবে ক্রেডিট কার্ড থাকে মূল চক্রের হাতে। টাকা ঢোকা মাত্র তারা তুলে নেয়।
মুনীম ফেরদৌস বলেন, অভিযানের সংবাদে পলাতক খোকন মোল্লার ছেলে বাপ্পি মোল্লাকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। আমরা জানতে পেরেছি খোকন মোল্লার মোবাইলে একদিনে প্রতারণার মাধ্যমে ৮ লাখ ৮৫ হাজার টাকা এসেছে। চক্রের জাকির হোসেন হাওলাদারকে গ্রেপ্তারের পর তার মোবাইল ফোনে দেখা গেছে, ২ লাখের বেশি টাকা আদান-প্রদান হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, গ্রেপ্তার আহাদ গাজী একটি মোবাইল অপারেটর কোম্পানির সিম বিক্রেতা। কোম্পানি থেকে টার্গেট থাকে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫টি সিম বিক্রি করতে হবে, বিক্রি করতে না পারলে তাকে চাপে থাকতে হয়। এজন্য বিভিন্ন লোক এলেই তাদের কাছে ৫০ থেকে ১০০ টাকায় সিম বিক্রি করেন। যদিও এই সিম ফ্রিতে দেওয়ার কথা। বিভিন্ন সাধারণ মানুষের সংগৃহীত এনআইডি ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে সিম বিক্রি। কেউ ফেরত দিলে সেটি পুনরায় বিক্রি করে এই প্রতারক চক্রের কাছে। ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকায় এসব সিম সংগ্রহ করে প্রতারণার কাজে ব্যবহার করে আসছে প্রতারক চক্রটি।