মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৩১ অপরাহ্ন

মসজিদের মাইকে ঘোষণা শুনেই গ্রামবাসীর গণপিটুনিতে ৪ ডাকাত নিহত

অনলাইন ডেস্ক / ৫৬ বার দেখা হয়েছে
প্রকাশিত : সোমবার, ১৮ মার্চ, ২০২৪

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে মসজিদের মাইকে ঘোষণা শুনেই গ্রামবাসীর গনপিটুনিতে ডাকাত সর্দারসহ ৪ ডাকাত সদস্য নিহত হয়েছে।

গত রোববার রাত দেড়টার দিকে উপজেলার কাঁচপুর ইউনিয়নের বাঘরী গ্রামের বিলে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর ঘটনাস্থল থেকে রাতে দুই ডাকাতের লাশ উদ্ধার করা হয়। পরে সোমবার সকালে আরো একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছেন।

তিনজনের লাশ উদ্ধারের পর ময়না তদন্তের জন্য নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করা হয়েছে। আরো একজনের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে রাখা হয়েছে। এ ঘটনায় সোনারগাঁও থানায় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

নিহতরা হলো ডাকাত সর্দার জাকির হোসেন। সে উপজেলার জামপুর ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের আমানউল্লাহর ছেলে, আব্দুর রহিম আড়াইহাজার উপজেলার কালাপাহাড়িয়া গ্রামের সামসুল হকের ছেলে ও নবী হোসেন একই উপজেলার জালাকান্দি গ্রামের আব্দুর মজিদ মিয়ার ছেলে। নিহত আরো একজনের নাম পরিচয় পাওয়া যায়নি। তার নাম পরিচয় সনাক্তের জন্য সিআইডি কাজ করছেন। আহত ডাকাত মোহাম্মদ আলী আড়াইহাজার উপজেলার জালাকান্দি গ্রামের নুরু মিয়ার ছেলে।

ঘটনার পর সোমবার সকাল ১০টার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার চাইলাউ মারমা, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (খ-অঞ্চল) শেখ বিল্লাল হোসেন ও সিআইডির উধর্বতন কর্মকর্তারা।

পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, উপজেলার কাঁচপুর ও সাদিপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের গত তিনদিন ধরে ডাকাতি সংঘটিত হয়ে আসছিল। গত শুক্রবার রাতে সাদিপুর ইউনিয়নের কাজহরদী কুন্দেরপাড়া গ্রামে বাড়ির মালিক ইসলাম মুন্সিকে কুপিয়ে দুই বাড়িতে ডাকাতি করে নগদ টাকা ও স্বর্ণলংকার লুট করে নিয়ে যায়। শনিবার রাতেও কাজহরদী এলাকায় ডাকাতির প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পরে এলাকাবাসী মাইকে ঘোষনা দিলে ডাকাতরা পালিয়ে যায়। গত রোববার রাতে ইউনিয়নের বাঘরী গ্রামের বিলে একটি টিলার মধ্যে ১০-১২ জনের একটি ডাকাত দল পার্শ্ববর্তী কাজহরদী গ্রামের বানিয়া বাড়িতে ডাকাতির প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এসময় স্থানীয় কয়েকজন তাদের দেখতে পেয়ে প্রথমে কাজহরদী গ্রামের মসজিদে মাইকে ডাকাতদের প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়। কাজহরদী গ্রামের মাইকে ঘোষনার পর আশপাশের ৫-৭টি গ্রামের মসজিদের মাইকে ডাকাত পড়েছে বলে ঘোষনা দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে গ্রামবাসী একত্রে হয়ে লাঠিসোটা ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ডাকাতদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে।

এসময় ডাকাত দলের সদস্যরা পালানোর চেষ্টা করলে তাদের ধাওয়া দিয়ে ধরে গণপিটুনি দেয়। ঘটনাস্থলেই দুইজন মারা যায়। অন্যরা পালিয়ে বিলের বিভিন্ন পুকুরের পানিতে ঝাঁপ দেয়। পরে তাদের পুকুর থেকে তুলে আরও তিনজনকে পিটিয়ে গুরুত্বর আহত করে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে নিহত তিনজনের লাশ উদ্ধার করে। আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজে নেওয়ার পর ডাকাত সর্দার জাকির হোসেনের মৃত্যু হয়। মোহাম্মদ আলী নামের এক ডাকাতকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র (পঙ্গু) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ওই ডাকাতকে পুলিশ পাহাড়ায় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

এদিকে সোমবার দুপুরে নিহতদের মধ্যে তিনজনের পরিচয় সনাক্ত হলেও আরো একজনের নাম পরিচয় পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ। নাম পরিচয় সনাক্তের জন্য সিআইডির একটি দল কাজ করে যাচ্ছে।

নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (খ-অঞ্চল) শেখ বিল্লাল হোসেন জানিয়েছেন ডাকাত সর্দার জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় অন্তত ১১টি মামলা রয়েছে। তবে ৮টিই ডাকাতির ঘটনায়। তার সহযোগী মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে একটি ডাকাতি মামলা আছে।

তিনি বলেন, সোনারগাঁয়ের একজন চিহ্নিত ডাকাত সর্দার জাকির। তাঁর বাড়ি উপজেলার জামপুর ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামে। তবে সে বড় হয়েছে কাঁচপুর ইউনিয়নের সুখেরটেক গ্রামের তার মামার বাড়িতে। মামা আনোয়ার হোসেনও ডাকাত দলের সদস্য ছিলেন। মামার হাত ধরেই জাকিরের ডাকাতির হাতেখড়ি। চিকিৎসাধীন মোহাম্মদ আলীর জবানবন্দিতে জাকির হোসেনের নেতৃত্বে গত তিনদিন ধরে ডাকাতির প্রস্তুতি নিচ্ছিল। শুক্রবার তারা কাজহরদী গ্রামে ডাকাতি সংগঠিত করে। ঘটনার দিন রাতে তারা প্রায় ১০-১২জন জন ডাকাতির উদ্দেশ্যে ওই বিলে জড়ো হয়েছিল।

সোনারগাঁও থানা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, জাকির হোসেন ২০২২ সালের তিন মার্চ উপজেলার সাদিপুর ইউনিয়নের নানাখী এলাকায় ডাকাতি করতে গিয়ে দুই সঙ্গীসহ গণপিটুনির শিকার হন। গত বছর উপজেলার মহজমপুর পশ্চিম পাড়া গ্রামে এক পুলিশ পরিদর্শকের ভাইয়ের বাড়িতে ডাকাতি করার পর গ্রেপ্তার হন। বিলটিতে ২০১৬ সালেও গ্রামবাসীর গণপিটুনিতে এক ডাকাত নিহত হয়েছিল।

বাঘরি গ্রামের গৃহবধু মোমেনা আক্তার, তাসলিমা বেগম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ডাকাতদের কারনে গ্রামের লোকজন পাহাড়ায় ছিল। রমজান মাসে এসে মনে হয়েছে কেউ চুরি, ডাকাতি করতে আসবে না। এখনও বিভিন্ন গ্রামের মাইকে ডাকাতের ঘোষনা আসলে আতংকিত হয়ে পড়তে হয়। রোববার রাতে ডাকাত ডাকাব বলে চিৎকার দিয়ে লাইট নিয়ে মানুষ বেড়িয়ে পড়ে। পরে শুনি ডাকাতদের পিটিয়ে মেরে ফেলেছে।

কাজহরদী গ্রামের মালেক মিয়া জানান, রমজান মাসেও ডাকাতদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে এলাকাবাসী। একই এলাকায় পর পর তিনদিন ডাকাতদের হানা। এমন পরিস্থিতিতে মানুষ বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেছে। শুক্রবার কুপিয়ে দুই বাড়িতে ডাকাতি করে সর্বস্ব লুট করে নিয়ে যায়।

বাঘরি গ্রামের আব্দুল ওয়াদুদ নামের এক যুবক বলেন, কাজহরদী এলাকা থেকে প্রথমে মাইকে ঘোষনা আসে ডাকাত এসেছে, সকলেই সতর্ক থাকুন। এক পর্যায়ে চকের মধ্যে বিভিন্ন দিক থেকে হাতে লাইট ও লাঠিসোটা নিয়ে দৌড়াতে থাকে। পরে আমাদের গ্রামের অনেকেই গিয়েছেন। সেখানে কে গিয়েছেন, কে যায়নি এখন কেউ স্বীকার করছেন না। তবে ডাকাতদের পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে এটা সত্য।

কাঁচপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নং ওয়ার্ড সদস্য মো. জাকির হোসেন বলেন, রাত দেড় টার দিকে চারপাশ থেকে বিভিন্ন মসজিদের মাইকে ডাকাত এসেছে বলে ঘোষনা হচ্ছে। মানুষ আতংকিত হয়ে লাঠিসোটা নিয়ে বিলের মধ্যে নেমে যায়। সেখানে হৈ চৈ করে ডাকাতদের পিটিয়ে হত্যা করে। অসুস্থ্য থাকার কারনে বিলে যেতে পারিনি। পরে পুলিশ এসে রাতেই দুইজনের লাশ উদ্ধার করে। আরো দুজনকে হাসপাতালে পাঠায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, ডাকাতির পেছনে পুলিশের অবহেলাই দায়ী। টহল ব্যবস্থা জোরদার করে না। এলাকাবাসীকেই নিজ উদ্যোগে ডাকাত পাহাড়া দিতে হয়। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে ডাকাতি সংঘটিত হলেও পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে চুরির মামলা দিতে বাধ্য করা করে। চুরির মামলায় পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তারের কোন উদ্যোগ নেয় না। ফলে বেপরোয়া হয়ে উঠে ডাকাত দল। মানুষেরও ধৈর্য্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। হত্যা হলো অপরাধের কাজ। এগুলো বেচে গেলে আবারও ডাকাতির করে যেতো।

পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ডাকাত মোহাম্মদ আলীর বরাত দিয়ে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার চাইলাউ মারমা বলেন, চিকিৎসাধীন মোহাম্মদ আলীকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে তারা ডাকাত দলের সদস্য। আট-দশজন মিলে বানিয়াবাড়িতে ডাকাতির জন্য বিলের একটি টিলার মধ্যে অবস্থান নেয়। এলাকাবাসী টের পেয়ে চারদিক থেকে এসে তাদের ধাওয়া দেয়। এক পর্যায়ে তারা পালিয়ে যাওয়ার সময় তাদের গণপিটুনি দেওয়া হয়।

নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, ডাকাতির প্রস্তুতি নেওযার সময় স্থানীয়দের গণপিটুনিতে ডাকাতরা নিহত হয়। তাদের বিরুদ্ধে একাধিক ডাকাতির মামলা রয়েছে। এ ঘটনায় সোনারগাঁও থানায় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। ঘটনা তদন্ত করে পুলিশ আইনগত ব্যবস্থা নেবে। ওই এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।


আরো সংবাদ পড়ুন...
এক ক্লিকে বিভাগের খবর