কিছুদিন পরেই রোজা। দাম বাড়ার শঙ্কায় আগেভাগেই নিত্যপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে মোহাম্মদপুরের টাউন হল বাজারে এসেছেন ফারুক হোসেন। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি। বাজার করতে এসে দেখেন এখন থেকেই বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বগতি।
গতকাল শুক্রবার বাজার করতে এসে দৈনিক বাংলার এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় তার। তিনি বলেন, ‘সবজির দাম সামান্য কমেছে। রোজার সময় যাতে সবকিছু কম দামে খেতে পারি সেই আশাই করি। তবে জানি, আমার এই আশা পূরণ হবে না।’
শুধু মোহাম্মদপুরে নয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের এই চিত্র ঢাকার বিভিন্ন বাজারে। শীতের ভরা মৌসুমে চড়া থাকা সবজির দাম সামান্য কমেছে। তবে বছরের অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় এখনো দাম বেশি। অন্যদিকে, পবিত্র শবেবরাতকে সামনে রেখে বেড়েই চলেছে গরুর মাংসের দাম। বাজারে অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যও চড়া দামে গিয়ে আটকে গেছে।
সকাল থেকে রাজধানীতে মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়ার কারণে গতকাল বাজারে ক্রেতার উপস্থিতিও কিছুটা কম ছিল। বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, শীতের সিম, মুলা, শালগম, ফুলকপি ও বাঁধাকপি এখন বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকার মধ্যে। যা গত সপ্তাহের চেয়ে প্রকারভেদে ১০-২০ টাকা কম। এরমধ্যে প্রতি পিস ফুলকপি ও বাঁধাকপি আকারভেদে ৩০ থেকে ৪০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া আলুর কেজি ৩০ টাকা, বেগুন ৬০-৮০ টাকা, পেঁপে ৪০ টাকা, টমেটো গাজার ও শসার কেজি ৪০ টাকা, চিচিঙ্গা ৭০ টাকা, কচুরলতি ৮০ টাকা, বরবটি ও করলা ৮০-১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
সবজি বিক্রেতা আবু কালাম বলেন, পটল, ঢেঁড়স, উচ্ছে, করলা, সজনের মতো নতুন আসা সবজিগুলোর দাম এখন বেশি। এগুলো নতুন আসাতেই দাম বেশি। কিছুদিন পরেই হয়তো দাম কমে যাবে।
আরেক বিক্রেতা হাবিবুল্লাহ বলেন, নতুন আসা সবজির দাম সব সময়ই বেশি থাকে। তবে অন্যান্য সবজির দাম কিন্তু কমে এসেছে।
অন্যদিকে, রোজার বাজারে প্রায় প্রতি বছরই দাম বাড়ে চিনির। এবার দাম কমাতে পণ্যটি আমদানিতে কিছুটা শুল্কছাড় দিয়েছে সরকার। এ ছাড়া ভোজ্যতেল চাল ও খেজুরের শুল্ক কর কমানো হয়েছে। তবে এসব পণ্যের দামে তার কোনো প্রভাব পড়েনি। রাজধানীতে এখন এক কেজি খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৪৫-১৫০ টাকায়। গত বছর একই সময়ে দর ছিল ১১০-১২০ টাকা।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারসহ বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, বর্তমানে পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি মিনিকেট ৬৪ থেকে ৬৬ টাকা, ভালো মানের নাজিরশাইল ৭৬ থেকে ৭৮ টাকা, নিম্নমানের নাজিরশাইল ৬৪ থেকে ৬৮ টাকা, আটাশ ৫০ থেকে ৫২ টাকা, স্বর্ণা (গুটি) ৪৮ থেকে ৫০ টাকা ও স্বর্ণা (পাইজাম) ৫০ থেকে ৫২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
এ ছাড়া প্রতি কেজি চিকন মসুর ডাল ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা, মোটা মসুর ডাল ১১০ থেকে ১২০ টাকা, মুগডাল ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা, ডাবলি ডাল ৮০ টাকা, অ্যাংকর ডাল ৮০ টাকা, ছোলার ডাল ১১০ টাকা, ছোলা ১২০ টাকা, মাষকলাইর ডাল ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
চালের দামের বিষয়ে জানতে চাইলে কারওয়ান বাজারের পাইকারি চাল বিক্রেতা মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘এ দেশে কোনো কিছু একবার দাম বাড়লে সেটি আর কমে না। চালের দাম বাড়ার সময় ৫-৬ টাকা বেড়েছে। আর কমার সময় কমেছে ১-২ টাকা। গত প্রায় এক মাস থেকে এমন বাড়তি দামেই স্থিতিশীল আছে চালের বাজার। যাদের টাকা আছে তাদের এই দামে কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু যাদের টাকা নেই নিম্নবিত্ত তারা সমস্যায় আছে। এটা আমরা বুঝি; কিন্তু আমাদের তো কিছু করার নেই। মিল থেকে দাম কমালে আমরা কমাতে পারি, নইলে তো আমরা চাইলেই কমদামে চাল বিক্রি করতে পারি না।’
মঈন উদ্দিন নামের আরেক বিক্রেতা বলেন, চালের বাজার স্থির আছে। দাম এখন আর বাড়বে না। তবে যদি দেশের বাইরে থেকে চাল আমদানি করা হয়, তাহলে দাম কিছুটা কমতে পারে। নইলে আগামী বৈশাখ পর্যন্ত দাম এমনই থাকবে। রমজান ঘিরে দাম আর বাড়ার শঙ্কা নেই। রমজানে চালের দাম বাড়ে না।
ডালের দামের বিষয়ে রাজধানীর রাজাবাজারের মুদি দোকানি মো. খোকন বলেন, ‘নির্বাচনের সময় ডালের দাম বাড়ে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে মুগডালের দাম। কেজিতে প্রায় ৫০ টাকা বেড়ে যায়। এ ছাড়া মসুর ছাড়া বাকি ডালও ১০-২০ টাকা দাম বাড়ে। এরপর আর কমেনি। এখনো সেই দামই আছে। ডালের দাম এখন আর বাড়বে কি না বলতে পারছি না।’
কারওয়ান বাজারের বিক্রেতা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ডাল আমদানি করতে হয়। ডলারের দাম বাড়ার কারণে ডালের দামও বেড়েছে। তবে গত এক মাস ধরে বাজার স্থিতিশীল আছে। ডালের দাম কমেওনি, বাড়েওনি।
এদিকে, বাজারে কেজিতে প্রায় ৫০ টাকা বেড়েছে গরুর মাংসের দাম। ভোটের আগে প্রতি কেজির গরুর মাংস ৬০০ টাকা পর্যন্ত নামলেও ভোটের পরে তা ৭০০ টাকায় গিয়ে ঠেকে। কিন্তু গত এক সপ্তাহে আরও দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ টাকায়।
গরুর মাংসের দাম বাড়ার বিষয়ে মাংস ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মুর্তজা বলেন, রোজা ও কোরবানিকে সামনে রেখে খামারিরা গরু বিক্রি কমিয়েছে। সে জন্য বাজারে সরবরাহ কম, দাম বাড়ছে।
গরুর মাংসের দাম বাড়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ক্রেতারা। মগবাজারে খুরশিদ মিয়া নামের একজন ক্রেতা বলেন, ‘কোনো কিছুর দাম কমছে না। একবার বাড়লে সেটা আর কমে না। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আমাদের দুঃখ দেখার কেউ নেই।’
এদিকে, বাজারে চড়া দামে আটকে আছে ব্রয়লার মুরগি ও ফার্মের মুরগির ডিমের দাম। প্রতি হালি বাদামি ডিম ৪৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে বড় বাজারে। আর পাড়া-মহল্লার দোকানে প্রতি হালি ডিমের দাম ৫০ টাকা, ডজন ১৫০ টাকা। এ ছাড়া ব্রয়লার মুরগির কেজি ২২০ থেকে ২৩০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
শতক পেরিয়ে যাওয়া পেঁয়াজের দাম এখনো কমেনি। প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১২৫ টাকায়। একই সঙ্গে চড়া দামে আদা ও রসুন দুই-ই বিক্রি হচ্ছে ২৪০ থেকে ২৬০ টাকা দরে।
কারওয়ান বাজারে সেলিম জেনারেল স্টোরের স্বত্বাধিকারী সেলিম হোসেন বলেন, ‘রোজা আসার আগেই ছোলার দাম বেড়ে গেল। আর শবেবরাত আসছে বলে বুটের ডালের দাম বাড়িয়েছে। আমরা তো খুচরা বিক্রি করি। আমাদের কি-ই বা করার থাকে। দাম বেশি থাকলে আমাদের বেশি দামেই বিক্রি করতে হয়।’