মৌলভীবাজারকে চায়ের রাজধানী বলা হয়। চয়ের পাশাপাশি পাহাড়-টিলায় ফলানো আনারস, লেবু, লিচু, আম, জাম ও কাঠালের খ্যাতি রয়েছে সারা দেশে। জ্যৈষ্ট মাস জুড়েই ফলের বাজারে বিভিন্ন দেশীয় জাতের পাকা ফল পাওয়া যায়। বিভিন্ন ধরণের পাকা ফলের মৌ মৌ ঘ্রাণে মুখর হয়ে উঠেছে শ্রীমঙ্গলের ফলের বাজার। শ্রীমঙ্গলে বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় এবার প্রায় ৪৩০ হেক্টর জমিতে আনারস চাষ হয়েছে।’
জেলার শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন অলিগলি কিংবা প্রত্যন্ত এলাকার গ্রামীণ হাটবাজার, সর্বত্রই এখন মৌসুমি রসালো ফল আনারসের মৌ মৌ ঘ্রাণ বিরাজ করছে। বাগান মালিকরা সকালের উপজেলার বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকা থেকে ঠেলাগাড়িতে করে তাদের চাষ করা আনারস বিক্রির জন্য শহরে নিয়ে আসছেন। এছাড়া সারা দিনই দূর দুরান্ত বাগান থেকে জিপ গাড়ি ও পিকআপ ভ্যানবোঝাই করে আড়তদারদের কাছে বিক্রির জন্য নিয়ে আসছেন পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ সুস্বাদু এ ফলটি।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা কৃষি অফিস জানায়, লেবু ও চায়ের পাশাপাশি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের আনারসের খ্যাতি রয়েছে দেশজুড়ে। উপজেলার মোহাজেরাবাদ, বিষামণি, হোসেনাবাদ, বালিশিরা, ডলুছড়া, সাতগাঁও, নন্দরানী, মাইজদিহিসহ উপজেলার বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকার জমিতে প্রতি বছরের মতো আনারসের চাষ হয়েছে ব্যাপক। অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার উৎপাদন ভালো হওয়ায় লাভের মুখ দেখছেন চাষিরা। পাশাপাশি আমদানি বেশি হওয়াতে আনারসের দাম সাধ্যের মধ্যে রয়েছে।
জানা যায়, ষাটের দশক থেকে শ্রীমঙ্গলের পাহাড়ি উঁচু-নিচু টিলায় আনারসের চাষবাদ শুরু হয়। বর্তমানে বিস্তৃত করা হয়েছে রসালো এ ফলের চাষ। এ অঞ্চলের উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু আনারস চাষের জন্য খুবই উপযোগী হওয়ায় সিজন ছাড়াও সারা বছরজুড়েই আনারসের ফলন হয়। মৌসুমের আনারসের সাইজ অনেক বড় হয়। স্থানীয়দের চাহিদা মিটিয়ে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জায়গার পাইকাররা ট্রাক, পিকআপ ভর্তি করে নিয়ে যান নিজ এলাকায় বিক্রির জন্য।
স্থানীয় আড়তদাররা জানান, অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার উপজেলার বিভিন্ন পাহাড়ি টিলায় চাষ করা আনারসের বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলে এখন মৌসুমি আনারসের দাম অনেক কম। মৌসুম ছাড়াও বছরজুড়ে শ্রীমঙ্গলে আনারসের চাষ করা হয়। তবে মৌসুমি আনারসের গঠন অনেক সুন্দর হয়। তাই মৌসুমি আনারস নিতে দূর-দূরান্ত থেকে ছোট-বড় পাইকাররা এসে নিজ এলাকায় পাঠিয়ে থাকেন। এছাড়া স্থানীয় গ্রামীণ হাটবাজারগুলোর মৌসুমি বিক্রেতারাও এখন রসালো আনারস নিয়ে যাচ্ছেন তাদের এলাকায়। ফলে উপজেলার সব হাটই ভরপুর এখন আনারসে। উৎপাদন বেশি ও ফলন ভালো হওয়ায় বাগান মালিকরা এক দিকে খুশি হলেও দামের কারণে কিছুটা অসন্তুষ্ট তারা। তবে বাগান মালিকরা দাম কিছুটা কম পেলেও স্থানীয় খুচরা ব্যবসায়ীরা ঠিকই চড়া দামে বিক্রি করছেন বলে ক্রেতারা জানান।
তবে খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, আনারস হচ্ছে কাঁচামাল, এখন গরমের সময়, তাই ফলটি বেশি সময় রাখা যায় না। অনেক আনারস পচে যায় এতে তাদের অনেক লস দিতে হয়। এবার আনারসের দাম কমই। বড় সাইজের আনারস ১২০ থেকে ১৪০ টাকা হালি (৪টায়) বিক্রি করা হয়। তাছাড়া মাঝারি সাইজের আনারস ৮০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যেই বিক্রি করা হচ্ছে। এছাড়া সাইজ বুঝে ৪০,৫০,৬০ টাকায় হালি আনারস বিক্রি করা হচ্ছে।
তারা আরও জানান, রাজধানী ঢাকা, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার বিশেষ করে হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ, শায়েস্তাগঞ্জ, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার বিভিন্ন উপজেলাসহ মৌলভীবাজারের বিভিন্ন পাইকাররা আসেন আনারস কিনতে।
শ্রীমঙ্গলের নতুন বাজারের পশ্চিমে শাপলা-শান্তিবাগ সড়কে সরজমিন দেখা যায়, প্রতিটি ঠেলাগাড়ির সামনের দিক মাটিতে ঠেকিয়ে তার ওপর আনারস সাজিয়ে রাখা হয়েছে। পাইকারি ও খুচরা ক্রেতারা এগুলো দেখে দরদাম করছেন। প্রতিটি ঠেলাতে সাধারণত ১০০ আনারস নিয়ে আসা হয়। ছোট আকারের আনারস হলে ১৫০ থেকে ২০০ পর্যন্ত এক ঠেলায় আনা যায়।
রেলস্টেশন এলাকার খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতা জাবেদ আলী জানান, ‘শ্রীমঙ্গলের আনারসের একটা আলাদা বৈশিষ্ট রয়েছে। এখানকার আনারসের ব্যাপক চাহিদা সারা দেশে। আমি প্রতিদিন খুচরা পাইকারি মিলিয়ে কয়েক হাজার আনারস বিক্রি করে থাকে। এখানে পর্যটকরা হচ্ছেন তাদের মূল ক্রেতা।’
আনারস চাষি সামছুল হক জানান, ‘তিনি প্রতি বছর দেশী জাতের আনারস চাষ করেন। এগুলো টক-মিষ্টি স্বাদের। তিনি জিপগাড়িতে করে আনারস বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন আড়তে। আড়তে নিলামের মাধ্যমে পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন। উৎপাদন বেশি হওয়ায় বর্তমানে আনারসের দাম অনেক কম।’
শ্রীমঙ্গল নতুনবাজারের আড়তদাররা জানান, ‘শ্রীমঙ্গলে ৩-৪শত পাইকার রয়েছেন আড়তদারদের তালিকাভুক্ত। মূলত চাষিদের কাছ থেকে আড়তদাররাই নিলামের মাধ্যমে আনারসগুলো নির্ধারিত দামে এ পাইকারদের কাছে বিক্রি করে থাকেন তারা। একঠেলা আনারস বিক্রি করে দিলে তাদের ১০০ টাকা কমিশন থাকে। এক একটা আড়ত থেকে দৈনিক ১০-২০ হাজার টাকার আনারসসহ কাঁচামাল বিক্রি করে থাকেন বলেও তারা জানান।’
শ্রীমঙ্গল উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, ‘শ্রীমঙ্গলের পাহাড়ি উঁচু-নিচু টিলায় ষাটের দশক থেকে আনারস চাষ শুরু হয়। এখানকার উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু আনারস চাষের জন্য খুব উপযোগী। উপজেলার বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় এবার প্রায় ৪৩০ হেক্টর জমিতে আনারস চাষ হয়েছে।’
মৌলভীবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক সামসুদ্দিন আহমদ বলেন, ‘মে থেকে জুন পর্যন্ত আনারসের ভরা মৌসুম। এবছর জেলার প্রায় দুই হাজার ১১০ হেক্টর জমিতে আনারসের চাষ হয়েছে। এবার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ২০ হাজার ৬০০ টন। চাহিদা বাড়ায় জেলার সদর উপজেলা, শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জের পাহাড়ি টিলাগুলোয় আনারস চাষে উৎসাহিত করা হয়েছে কৃষকদের।’