মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:২৫ অপরাহ্ন

পান্থজনের সখা-একজন নিবৃত্তচারী “আহমদ সিরাজ”

শামীম মেহেদী / ১৩২ বার দেখা হয়েছে
প্রকাশিত : শুক্রবার, ১৪ জুন, ২০২৪

অফুরান সৌন্দর্যের লীলাভূমি, নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর, কর্মদক্ষ প্রান্তিক মানুষের অবধারিত বৈচিত্রের আস্থারভীত, ইতিহাস, শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব, লেখক, গবেষক, যার চোখে-কমলগঞ্জকে দেখা গেলে সারা বাংলাদেশের অর্ধেক দেখা হয়ে ওঠে-তিনি আহমদ সিরাজ।

জাতপাত, আদিবাসী সমাজ সংস্কৃতির লোককথক অথবা ইয়াসিন শাহ ও তার সাধন তত্ব, সুরমা থেকে সাগরের প্রান্থজনে বসতি করে যে- রাজনৈতিক চিন্তক, বিশ্লেষক সংশ্লিষ্ট তাঁর প্রকাশের ধরণ, যা সমানতরাল, তাই হয়তো তিনি খুঁজেন অন্যচোখে, সাংবাদিকতা,কলামনিষ্ঠ-বহুমাত্রিকের সাথে ” পান্থজনের সখা ” গালগল্পেরই আয়োজন। যা অনেকটা সাক্ষাৎকারভিত্তিক, সাঁকো পেরোনোর মতো হেলেধুলে, কথার ছলে, সাথে ছিলাম আমি- শামীম মেহেদী।

  • অনেক অভিধায়ে আপনাকে অলংকৃত করা হয়েছে, যা অনেকটা সব্যসাচীর চিহ্ন বহন করে, নিজেকে নিয়ে, নিজের স্বপ্নকে নিয়ে মুল্যায়ন করতে বলা হলে কি বলা যেতে পারে?

আ.সি.-অনেক অভিধায়ে অনেকটা সব্যসাচীর আদলে যারা দেখে থাকেন, তাদের ভালোবাসার কাছে অনেক ঋণ আছে। নিজের সীমাবদ্ধতা ও গার্তির কাছে নিজেকে এতটুকু ভাবার সুযোগ নেই, জীবনভর একজন পায়ে হাটা মানুষ হিসেবে যেভাবে দেখে এসেছে , বিবেচনায় রেখেছে, তার মূল্য নিজের কাছে অপরিসীম। মানুষ বিশেষত -তলা’র মানুষের দুঃখের সকালে ও বিকালে সহায়ক হয়ে ওঠার চেষ্টায় তাড়িত থেকেছি।

এছাড়া মানুষের নানা কাজের ভেতর সহায়ক হয়ে ওঠার চেষ্টার মধ্যে আলাদা কোন কৃতিত্ব বা নিজেকে বিরাট কিছুর ভাবার মতো বুকামির কিছু নেই। মানুষ দিনরাত যে শ্রমঘাম ঝড়িয়ে, যে নান্দনিকশিল্প তৈরী করে থাকে, তা ঠিকমতো বুঝে নিলে নিজেকে বিরাট কিছু ভাবার সুযোগ নেই। ডিগ্রির বিদ্যাবুদ্ধি দিয়ে এগুলো বুঝে নেয়া যত সহজ মনে করা হয়, আসলে তত সহজ নয়। নিরবধি মাঠে ঘাঠে ঘুরতে গিয়ে এমন উপলব্ধি নিজেকে বিনিত করেছে। গ্রহের মানুষ হিসেবে, গৃহের মানুষ হিসেবে, সর্বপরি দেশের মানুষ হিসেবে স্বপ্নের ভীত বহুমাত্রিক হয়ে ওঠতে পারে। নিজের স্বপ্ন এসবের ভেতর পড়ে আছে। যা ঠিকমতো বুঝে নিলে স্বপ্নযাত্রা অনিঃশ্বেষ।

**সাম্প্রতিক সময়ে একটি জাতীয় দৈনিক আপনাকে সম্মানিত করেছে, তৃণমূলে থেকেও আপনার কর্মযজ্ঞ আমাদের প্রানোদিতকরে, প্রজন্মের প্রান্তিকতা কি শহরের শিল্প সাহিত্য মিডিয়াবাজদের গোষ্ঠীবদ্ধতার কাছে ম্লান?

আ.সি.-ঠিকই বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে দৈনিক প্রথমআলো সহ বেশকিছু পত্রিকা সম্মানিত করেছে। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের কিছু এ্যাওয়ার্ড আমাকে কৃতজ্ঞ ও সম্মানিত করেছে। তবে এসব ব্যাক্তির মুল্যায়নের চিহ্ন হলেও প্রকৃত ভালোবাসা থেকে উৎসারিত এসবের মুল্যায়ন বেশী।

পদক, সম্মাননা প্রবৃত্তি ব্যাক্তির সৃজনশীলতার মাপকাঠি হয়ে উঠলে বা ভাবনার অংশ হয়ে উঠলে সৃজনশীলতা ম্লান হয়ে উঠতে পারে। আসলে এসব মুল্যায়ন একটা আপেক্ষিক সত্যকে বহন করে। মোটাদাগে যে স্বপ্ন, যে লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের অভূয়্যদয় ঘটে ছিলো, এখন ৫২, ৫৩ বছরে এসে দেশের এমন অগ্রযাত্রায় ও দেশের কুটি কুটি তরুণযুবক মন ও মননে স্বদেশ পলাতক হয়ে উঠছে, যা সুখকর নয়, আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ও আলাদা কিছু নেই।

মনে রাখতে হবে- যে সমাজের উপরি কাঠামো ও ভীত্তি কাঠামো বেহাল অবস্থায় থাকে, সেই সমাজ বা দেশে সর্বাঙ্গে ব্যাথা থাকে,আমাদের ক্ষেত্রেও হয়তো তাই। তেমন সমাজে শিল্প সাহিত্যে গোষ্ঠীবদ্ধতা ও আধিপত্যতা থাকে, তাতে প্রকৃত সৃষ্টি হারিয়ে যায় না।

এই প্রসঙ্গে ড. আনিসুজ্জামান স্যারের একটি উক্তি টানা যেতে পারে, কমলগঞ্জের ভাষা ও বৈচিত্র তাঁর হাতে পৌছার পর সরাসরি আমাকে ফোনে জানান “মনে রাখবেন ঢাকা ও মফস্বল বলে কিছু নেই, সৃষ্টির কোন ভৌগলিক সীমারেখা নেই, আপনারা ভালো কাজ করেছেন।” কাজেই প্রান্তিক সাহিত্য, গোষ্ঠীবদ্ধ সাহিত্য ইত্তেকার চিহ্ন বহন করলেও জীবন ও জগৎ সত্য।

***আপনার বাড়ীই-একটি পাঠাগার,রাজনৈতিক মতাদর্শ? কমরেড আবু জাফর আহমদ আপনার একটি বইয়ের প্রকাশক ছিলেন? একজন উপজেলা প্রশাসক বলেছিলেন, একজন সরকারের চাকুরীজীবি হওয়া যতটা সহজ আহমদ সিরাজ হয়ে ওঠা ততটা সহজ নয়, কি বলবেন…

আ.সি. সৈয়দ আবু জাফর আহমদ একজন কেবল রাজনৈতিক ব্যাক্তিত ছিলেন না, তিনি ছিলেন সার্বক্ষনিক পেশাদার রাজনৈতিক হিসাবে ধ্রবতারার মতো। তিনি ছিলেন একজন সাংবাদিক,লেখক যা ঠিকমতো দৃশ্যমান হয়ে ওঠলে তিনি বিরাট লেখকসত্ত্বায় পরিনত হয়ে উঠতে পারতেন।

বিনয়ের সাথে একটি কথা বলতে চাই, আমি লেখক না কর্মী, সংগঠক তা আজ ও আমার কাছে স্পষ্ট নয়, নানা কাজের পাশাপাশি- প্রশাসনের লোক জনের সাথে একটা কাজের সম্পৃক্তা থাকে, যদিও নিজে একজন রাজনৈতিক ও সমাজকর্মী যা আন্দোলন, প্রতিবাদের মধ্যে দিয়ে তার সুরাহা খোঁজা হয়। আমি নিজে মনে করি আমরা এখন আর কোন বিদেশি উপনিবেশিক সরকারের অধিনে নেই, আমাদের নানা ঝামেলার মাঝে ও প্রশাসনকে মানুষের স্বার্থে সহায়ক হয়ে ওঠা ও একটি কাজ। এ দৃষ্টিকোন থেকে প্রশাসনের অনেক ইতিবাচক ভূমিকা তৃণমূলে লোকজনের স্বার্থে একটা চেষ্টা রেখেছি। তাতে অনেক সুফল আছে। তবে এক্ষেত্রে সতর্ক না থাকতে পারলে লাভেমূলে তল হওয়ার ঝুঁকি আছে। এ ক্ষেত্রে জানাবুঝার ভালো সম্পর্ক আছে যা ব্যাক্তি ও সমষ্টিকে চিহ্নিত করে।

****কবি দিলওয়ার প্রায়শ আপনার বাড়িতে আসতেন। আমি ও একদিন তাঁর সঙ্গী হয়েছিলাম, তিনি আমাকে “শামীম মেহেদী কল্যানেষু ” কবিতা উপহার দিয়েছিলেন, আপনার বাড়িতে বসেই। কবি নৃপেন্দ্রলাল দাস সেই সময় উপস্থিত ছিলেন,আপনাদের শিল্পসাহিত্যের সেইসব দিন…

আ.সি.-আপনি কবি দিলওয়ারের প্রসঙ্গ টেনেছেন, যা এমন একটি নাম, যা আমার জীবনের অস্থিমজ্জার অংশের মতো হয়ে আছে। আমার সুভাগ্য যে এমন একজন কবিকে এত নিবিড় ভাবে জানাবুঝার সুযোগ হয়েছে। ঠিকমতো যোগ্যতা থাকলে তার একটা বিরাট মুল্যায়নের সুযোগ ছিলো,বাংলা সাহিত্যে যোগ্যতাসম্পর্ন তারমতো কবি আছেন বুঝে নিয়ে এ টুকু বলা যায় যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে দিলওয়ার এক স্বতন্ত্রর ধারার কবি প্রতিভা। ঢাকা ও জাতীয় সাহিত্যের দিগবলয়ে তাকে এখনো সচেতন ভাবে এড়িয়ে চলার প্রবনতা আছে, দিলওয়ার কবিতার দিগ থেকে এত শক্তিশালি যে তার তুলনা সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দের প্রমূখের তুলনা করলে তার কবিতার শক্তিমত্তা বুঝেনেয়া যেতে পারে।

এছাড়াও দিলওয়ার ছিলেন একজন সার্বক্ষনিক কবি ভেতর ও বাহিরে সমান। এ কথা সত্য যে আপনি সহ কত কত লোকজন শ্রীনাথপুরে কবি সান্নিধ্যে এসেছেন তা কোন ডায়রি লিখে রাখা হলে বিরাট গ্রন্থের অবয়ব হয়ে ওঠতে পারতো। মনে পরে কবি রিসি দলাই সহ চারবাকের উদ্যোগে ঢাকায় দিলওয়ার উৎসবের আয়োজন পালন করা হয়।

এছাড়াও কমলগঞ্জে গ্রামের পর গ্রামে দিলওয়ার কে নিয়ে আড্ডা, কথা বলা, সভা ইত্যাদি যেভাবে হয়েছে তার দ্বিতীয় কোন উদাহরণ জানা নেই। দিলওয়ার মনে করতেন কমলগঞ্জ তার দ্বিতীয়সত্তা। এখানে এসে যেখানে গেছেন তিনি লিখেছেন ছড়াকবিতা। এগুলো ঠিক মতো সংগ্রহিত হলে একটা গ্রন্থ হয়ে উঠতে পারে। এখানে কমলগঞ্জের দুজন শিল্পী একজন বাপ্পি সিংহ তার রচিত গান সুর করে গেয়েছেন, তেমনি আরো একজন শিল্পী রমাকান্ত গোয়ালা এখানে রচিত তার গান সুর করে গেয়েছেন। দিলওয়ারের অনেক গান ও কবিতা কমলগঞ্জে স্মৃতির আকর হয়ে আছে।

*অনেকের মতো আহমদ সিরাজ কে ও বাজারের ব্যাগ হাতে সবজি নিয়ে বাড়ী ফিরতে হয়, ভাবি সবজির ব্যাগে পত্রপত্রিকা ম্যাগাজিন দেখে কি করেন? পরিবার সম্পর্কে জানতে চাই…

আ.সি.- মুলত একটা লোকায়ত সাংস্কৃতিক পরিবেশে আমাদের পরিবারের ভীত গড়ে ওঠেছে। এখনো এ ধারা নিঃশ্বেষ হয়ে যায় নি। যদি ও ক্রমশ গ্রাম ও শহরের পার্থক্য কমে আসার প্রবনতা বাড়ছে, তথাপি আমাদের পূর্বপুরুষের অবস্থানটির অদলবদল এত দ্রত হয়ে ওঠেনি। নিজে বিরাট পরিবারের কেউ না হলে ও একটা মসৃণ ঐতিহ্য বরাবর বহন করেছি, যা বাবা চাচা বা তার আগে থেকেই বাড়িতে, গ্রামের পরিধিতে লোকজ সংস্কৃতির একটিবাতাবরণ থেকেছে। বাল্যকালে বাড়িতে পুঁথিপাঠ ও কিচ্ছাকাহিনি শুনতে শুনতে যাত্রা নাটক ইত্যাদি দেখা ও জানাবুঝার মাঝে সংস্কৃতির একটা হাওয়ায় তাড়িত থেকেছি। তার প্রভাব একটা ছিলো।

আজও অবদি নিজস্ব বলয়ে সাহিত্যের একটা আড্ডা নেই বলা যাবে না। যদিও আগের মতো তা আর নেই। এসব দেখে ঘরের গৃহিণী অভ্যস্থ হয়ে যান, তিনি ডিগ্রিধারি কোন নারী না হলেও ঘ্রাণে এসব বুঝে নেন বলে মনে হয়। তিনি এসবের সহায়ক থেকেছেন। ব্যগে বই থাকলো না সবজি থাকলো তাতে তার কোন সমস্যা নেই। তার আলাদা কোন চাহিদাও নেই। তার কিংবা আমাদের পরিবারে নিজেকে ভার্তিভাবে (বর্ধিতকারে) বুঝানোর আগ্রহ ও নেই, যা আয় রোজগার হয় তার ভেতরই নিজেকে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা হয়েছে। এ ভাবেই আছে। আমরা একটা আটপৌরের পরিবারের সহজ মানুষ।

গ্রন্থনা, উপস্থাপন
শামীম মেহেদী
shamimsfashion09@gmail.com


আরো সংবাদ পড়ুন...
এক ক্লিকে বিভাগের খবর