পাহাড়, আর পাহাড়ের কোলঘেঁষে বয়ে যাওয়া পানির ঝর্ণাধারা ও গাছগাছালির অপরূপ শোভায় প্রকৃতির কোলে গড়ে ওঠা বান্দরবানের নৈস্বর্গিকতাকে গ্রাস করছে সহিংসতা এবং আতঙ্কের কালো মেঘে। বান্দরবানের রুমা, থানছিতে গত কয়েক দিন ধরে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সশস্ত্র সহিংসতা, মসজিদে হামলা, ব্যাংক ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের টাকা ও থানার অস্ত্র লুঠের ঘটনায় পাহাড়ের কোলে প্রকৃতির নৈস্বর্গিকতায় গড়ে ওঠা বান্দরবানের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ,আতঙ্ক বিরাজ করছে। বান্দরবানসহ তিন পার্বত্য জেলার মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন, তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরত দেখা দেয়। শঙ্কার মধ্যে সরকারের ঐকান্তিকতায় যৌথবাহিনী, সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, র্যাবের নিরন্তর প্রচেষ্টায় পার্বত্য ঐতিহ্য বৈষাবি এবং বাংলা নববর্ষে বৈশাখী উৎসব, মুসলমানদের পবিত্র ঈদ উৎসবের সব আয়োজন সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছে। পাশাপাশি ঈদ, বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে টানা সরকারি ছুটিকে কেন্দ্র করে ভ্রমণপিপাসু মানুষ এই তিন জেলার প্রকৃতির অপরূপ শোভামণ্ডিত এবং নয়নাভিরাম পর্যটন স্পট ভ্রমণ সীমিত আকারে হয়েছে। এসব বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে সরকারের শীর্ষমহল থেকে শুরু করে গোয়েন্দা সংস্থা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, আমাদের চৌকস সশস্ত্র বাহিনীর সমন্বিত উদ্যোগ অব্যাহত রাখা দরকার। তবে এ ক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে দেশের অখণ্ডতা, নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও শান্তি রক্ষায় প্রয়োজন রাজনৈতিক ঐক্য ও সিদ্ধান্ত।
উল্লেখ্য পাহাড়ি জনপদ বান্দরবানে কেএনএফএর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুধু পার্বত্য অঞ্চলের জনগণের জন্য নয় একই সঙ্গে সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য নতুন করে চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। প্রসঙ্গত গত ২ এপ্রিল সন্ধ্যার পর রুমা উপজেলায় সোনালী ব্যাংকে হানা দেয় কেএনএফ। এ সময় তারা পুলিশ ও আনসার বাহিনীর ১৪টি অস্ত্র এবং ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক নেজামউদ্দিনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। ১৬ ঘণ্টা না যেতেই ৩ এপ্রিল দুপুরে একই সশস্ত্রগোষ্ঠী থানচি উপজেলার কৃষি ও সোনালী ব্যাংক থেকে প্রায় ১৭ লাখ টাকা লুট করে। পরদিন ৪ এপ্রিল রাত সাড়ে ৮টার দিকে থানচি থানা লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে কেএনএফ। অবশ্য ইতোমধ্যে প্রায় অর্ধশত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে তাদের জেলে পাঠিয়েছে। চলছে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান। উদ্ধার হয়েছে অপহৃত ব্যাংক ম্যানেজার; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেএনএফের সঙ্গে বান্দরবানের শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির দফায় দফায় আলোচনার মধ্যে কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো? অন্যটি হচ্ছে: সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গাফেলতিতে রুমা ও থানচিতে এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অবতারণা কি না- এসব বিষয়ে খতিয়ে দেখা দরকার।
বিগত দিনে দেখা গেছে, যখনই পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলো আর্থিক অস্ত্র সংকটে পড়ে তখন তারা নিজেরা অভ্যন্তরীণ কোন্দলে, জড়িয়ে পড়ে। আর তখনই চাঁদাবাজি, লুঠরাজ ও সহিংসতায় লিপ্ত হয় এবং তখন তাদের শক্তি, সার্মথ্য, সক্ষমতা জানান দিতে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। বিগত দিনের ঘটনাগুলো পর্যালোচনায় এমনটি প্রমাণ হয়। যদি তাই না হয় তাহলে শান্তি আলোচনার আড়ালে কেএনএফ ব্যাংক, থানা লুঠ, মসজিদে হামলা করবে কেন? তারা অর্থ সংগ্রহে মনোযোগী হলো কেন? এ কারণে তাদের সঙ্গে শান্তি আলোচনার পাশাপাশি শতভাগ সতর্কতা বজায় রেখে সংকট নিরসনে মনোযোগ দেওয়া দরকার ছিল; কিন্তু তা সম্ভবত করা হয়নি। কারণ থানা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তায় আগ থেকে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিলে হয়তো ব্যাংক লুঠ ও থানায় হামলা, অস্ত্র লুঠ ঠেকানো যেত। আর এ কারণেই রুমা ও থানছি এসব ঘটনাকে নিছক ‘ব্যাংক ডাকাতি’ বা ‘আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা’ হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। এসব সহিংসতার মধ্য দিয়ে কেএনএফ সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতিও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। কাজেই এর নেপথ্যে তাদের সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, আন্তর্জাতিক সংযোগ, আঞ্চলিক ও চীন-মিয়ানমারের ভূরাজনৈতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে তা খতিয়ে দেখা দরকার। কারণ এই নব্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও সামরিক শক্তি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে শুধু সাময়িক অভিযানে সুফল মিলবে না।
প্রসঙ্গত, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পাহাড়ের বিবাদমান রক্তক্ষয়ী সংঘাত, সহিংসা বন্ধে আমাদের সেনাবাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা জাতি চিরদিন কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে। কারণ বিগত সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে অভিযান পরিচালনার প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রয়েছে। এদিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণ নেতৃত্বে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ওই অঞ্চলের রক্তক্ষয়ী সংঘাত বন্ধ ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি ’ স্বাক্ষরিত হয়। পরে পার্বত্য শান্তিচুক্তির ফলে পাহাড়ি জনগণের বিশেষ অবস্থান ও মর্যাদার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এতে পাহাড়ের রক্তাত্ত জনপদে প্রত্যাশিত শান্তি ফিরে আসে একই সঙ্গে পাহাড়ি বাঙালির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় চলে উন্নয়নের মহাযজ্ঞ।
অবশ্য ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের আইজিপি, র্যাব, বিজিবি, সেনাপ্রধান বান্দরবান সফর করে পাহাড়ি জনপদে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একই সঙ্গে কেএনএফ নির্মূলে সাড়াশি অভিযানের ঘোষণা দিয়েছেন। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও সেখানে অভিযান পরিচালনা করেছে। অভিযানে কেএনেএফের প্রধান নাথান বমের ঘনিষ্ঠ কেএনএফের ‘প্রধান সমন্বয়কারী’ চেওসিম বমসহ দুজন র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে। এ নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-১৫-এর অধিনায়ক কর্নেল সাজ্জাদ হোসেন এই তথ্য জানিয়েছেন।
অন্যদিকে, বম জনগোষ্ঠীর বেশ কয়েকজন নাগরিক বলেছেন, চেওসিম বমের শ্যারণপাড়ার বাড়িতে কেএনএফ প্রধান নাথান বমের সঙ্গে জঙ্গিগোষ্ঠী জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়ার প্রধান সমন্বয়কারী শামীম মাহফুজের বৈঠক হয়েছিল। ২০২১ সালের শেষে ও ২০২২ সালের প্রথম দিকে এমন বৈঠক হয়। কারও কারও মতে তার বাড়িতেই কেএনএফের সঙ্গে জঙ্গিগোষ্ঠী শারক্কীয়ার চু্ক্তি হয়েছিল। মাসিক তিন লাখ টাকার চুক্তিতে জঙ্গিদের কেএনএফ সদস্যরা প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল।
অন্যদিকে, কেএনএফ সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা মারমার নেতৃত্বে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা’ কমিটি গঠন করা হয় গত বছরের মে মাসে। ওই কমিটির সঙ্গে গত ৫ মার্চ দ্বিতীয় দফা বৈঠক হয় বেথেল পাড়ায়। শান্তি আলোচনার মধ্যেই ২ এপ্রিল বান্দরবানের রুমায় সোনালী ব্যাংকে ও পরদিন ৩ এপ্রিল থানচির সোনালী ও কৃষি ব্যাংকে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে ১৭ লাখ টাকা, দুটি লাইট মেশিনগানসহ (এলএমজি) ১৪টি অস্ত্র লুট করে নিয়ে যায় কেএনএফ সদস্যরা। পাশাপাশি সোনালী ব্যাংক রুমা শাখার ব্যবস্থাপক নিজাম উদ্দিনকে অপহরণ করে নিয়ে যায় তারা। পরপর দুই উপজেলায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পর এই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনীসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী।
খবর অনুযায়ী কেএনএফ ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে তৎপরতা শুরু করে। পাহাড়ে তাদের আস্তানায় সমতলের নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়ার সদস্যরা সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন বলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এর আগেও গণমাধ্যমকে জানিয়েছিল। সেই আস্তানায় গত বছর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়া ও কেএনএফের বেশ কিছু সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। সংশ্লিষ্ট মহলের খতিয়ে দেখা প্রয়োজন কেএনএফকে কারা অস্ত্র সরবরাহ, অর্থ, বৈদেশিক সাহায্য দিচ্ছে। কাজেই কেএনএফকে অস্ত্র, অর্থ ও জনসমর্থন থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। এটা করা না গেলে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অপূর্ণতা থেকে যাবে। তাই নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য বান্দরবানে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শান্তি আলোচনা ভেস্তে গেলেও সরকারের উচিত সংলাপের জন্য পথ উন্মুক্ত রাখা। একই সঙ্গে ওই অঞ্চলের মানুষের মৌলিক চাহিদা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন কর্মসূচির যথাযথ বাস্তবায়ন। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মি, মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের মতো সংগঠনের সঙ্গেও এদের যোগাযোগ আছে।
আগের মতো পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখার স্বার্থে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দিতে পারে। পাশাপাশি বিজিবি, র্যাব, পুলিশ তাদের নিয়মিত টহল, তল্লাশিতে নিয়োজিত করা দরকার। এ ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে, যে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের যেন ক্ষতি না হয়। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন পাহাড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা ও সংস্কৃতি পাহাড়, বন, নদীনির্ভর। তাদের জীবন-জীবিকা, সংস্কৃতি, অধিকার সমুন্নত থাকলে কেএনএফের মতো কোনো স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী অপতৎপরতা চালাতে সাহস করবে না। প্রত্যাশা পাহাড়ে শান্তি আসবে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়।
লেখক: সাংবাদিক