শুধু মানুষই নয়, এ বিশ্বভ্রমাণ্ডে যত জীব-জন্তু পশু-পাখি, কীটপতঙ্গ বিরাজমান তা সবই আল্লাহর সৃষ্টি। সৃষ্টির এ বৈচিত্র্যময়তা পৃথিবীকে দান করেছে সৌন্দর্য, করেছে ঐশ্বর্যমণ্ডিত ও আকর্ষণীয়। আর সৃষ্টির সবকিছু সঠিক ও সুন্দরভাবে পরিচালনা করার জন্য সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষের মধ্যে তিনি শক্তি, বুদ্ধি ও বিবেক দিয়ে দিয়েছেন।
তাই মানবপ্রেমের পাশাপাশি অন্য সব প্রাণীর প্রতি যত্নবান হলে, তাদের ভালোবাসলে সৃষ্টিকর্তাও খুশি হন। জীব-প্রেম যেন স্রষ্টার প্রতি আনুগত্যেরই নিদর্শন। এ জন্যই স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’।
এই আদর্শকে ধারণ করে সমাজে অল্প হলেও এমন কিছু মানুষ আছে অন্য প্রাণীর প্রতি যাদের ভালোবাসার বিশালতা আমাদের কল্পনাকেও হার মানায়। যারা ভালোবাসা ছড়িয়ে দেন সবখানে, সকল প্রাণে। তাদের সেই ভালোবাসা, যত্ন আর মায়ায় ভালোভাবে বেঁচে থাকে অসহায় ও অবহেলিত অনেক পশু-পাখিও।
পথের ধারে পড়ে থাকা কুকুর-বিড়ালের কথা আমরা কজনেই বা ভাবী? খাবারের অভাব থেকে শুরু করে মানুষের নানা নির্যাতনের শিকার হতে হয় এদের। এই প্রাণীগুলোকে বাঁচাতে মাদারীপুরের শিবচরের বাসিন্দা জেরিন আক্তার নিয়েছেন ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। নিজ বাড়িতেই গড়ে তুলেছেন এসব আহত প্রাণীদের আশ্রয়স্থল। স্বামী, সন্তান ছাড়াও তার পরিবারের সদস্য এই বিড়াল ও কুকুর। এসব প্রাণী তার কাছে সন্তানের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। একটি-দুটি নয়- বর্তমানে ২৯টির বেশি বেড়াল রয়েছে তার বাড়িতে।
এগুলো সবই বেওয়ারিশ প্রাণী। কিছুদিন আগেও যাদের স্থান ছিল রাস্তায়। নির্যাতনে পঙ্গু হয়েছে এমন বিড়ালদের ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উদ্ধার করে আনেন তিনি। তাদের সেবা দিতে গিয়ে নিজের বাড়িকেই বানিয়ে ফেলেছেন ‘বিড়ালের স্বর্গ’।
জেরিন বলেন, ‘ছোট থেকেই কুকুর-বিড়াল খুব ভালোবাসি। জীবনের প্রথম বিড়ালের নাম ঝুনঝুনি। বলতে পারেন আমার এক সন্তান। এক দিন তাকে এক লোক ৬তলা থেকে ফেলে দেন। আমি এমন সময় খবর পাই যখন কিছুই করার ছিল না। আমার হাতেই ও মারা যায়। ওই মুহূর্তটি কতটা কষ্টকর ছিল তা প্রকাশ করা সম্ভব না। এর পর থেকেই মনে হতো রাস্তায় কত কুকুর-বিড়াল অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে, কষ্ট পাচ্ছে। ওরা তো কথা বলতে পারে না। এই চিন্তা থেকেই প্রথমে একটি, পরে দুটি; এমন করতে করতে এখন ২৯টির বেশি বেড়াল রয়েছে আমার কাছে।’
এই পশুপ্রেমিকের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, চারদিক ছোটাছুটি করছে বিড়ালগুলো। তাদের রয়েছে রকমারি নাম। বিড়ালের ভাষা বোঝেন জেরিন। বিড়ালও বুঝতে পারে তার কথা। ডাক দিলেই ছুটে আসে কিংবা সাড়া দেয় ছোট-বড় বিড়ালের দল। ৫ বছর সময় ধরে কুকুর-বিড়াল লালন-পালন করছেন তিনি। এ ছাড়া অর্ধশতাধিক পথের কুকুরকে নিয়মিত খাবার দেন তিনি।
এসব কাজ শখের বশে নয়, প্রাণীদের প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ থেকেই করেন। জেরিন বলেন, ‘এক সময় পরিবার এসব পছন্দ করত না। আমার বরের জন্যই এত কিছু করা সম্ভব হয়েছে। সে সব সময় আমাকে সাহায্য করে। সেটা আর্থিক হোক বা মানসিক। আর আত্মীয়দের অনেকেই বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখেন না। তারা বাসায় খুব কম আসেন। আমি কুকুর-বেড়াল পালি বলে অনেকের মতে আমি নাকি পাগল।’
শুধু এসবের মধ্যেই থেমে নেই এই পশুপ্রেমিকের কর্মযজ্ঞ। বিড়ালদের স্থায়ী নিবাসের জন্য শিবচরে নির্মাণ করেছেন ‘শেল্টার সেন্টার’ বা আশ্রয়কেন্দ্র। যদিও এর কাজ এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। প্রায় এক কাঠা জমির ওপর জমানো ও ঋণের টাকা দিয়ে করছেন এই কাজ। তিনি বলেন, ‘আমার ছোট ভাই ও আমি দেখাশোনা করি ওদের (বিড়াল)। সবচেয়ে বড় সাপোর্ট আমার ভাই দেয়।’
ইচ্ছেশক্তি থাকলেই অনেক অসাধ্যকে যে সাধন করা যায় মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে জেরিন তার উদাহরণ। দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে যখন চারদিক নাভিশ্বাস অবস্থা তখন এই প্রাণীদের দেখভালে প্রতিমাসে মোটা অঙ্কের টাকা ব্যয় করতে হয় তাকে। তিনি বলেন, ‘‘প্রায় ২৫ হাজারের মতো মাসে খরচ হয়, আবার সব সময় এক রকম খরচ হয় না। কারণ শেল্টারের বাচ্চাদের পাশাপাশি প্রতি রাতে রাস্তার কুকুরদেরও খাবার দিই আমি। আমার শেল্টারে যতগুলো বাচ্চা আছে প্রায় সবাই অসুস্থ। কেউ চোখে দেখে না, কারও পা নেই, আবার কেউ প্যারালাইসড। কিছু টাকা মানুষ সাহায্য করে যারা পশু-পাখি ভালোবাসে, কিছু টাকা আমার ‘ফস্টার হোম’ থেকে আসে। এ ছাড়া কিছুটা আমার বর প্রতিমাসে সহযোগিতা করে।’’
শহরের তুলনায় গ্রামে এসব প্রাণী বেশি নির্যাতনের শিকার হয় জানিয়ে জেরিন বলেন, ‘এখন আমার লক্ষ্য গ্রামের মানুষের সচেতন করা। আমরা সামান্য কিছু হলেই ওদের আঘাত করি, এসব বন্ধ করতে চাই। ওদের নিয়ে মানুষের ভেতর যে ভুল ধারণা আছে বদলাতে চাই। সেই সঙ্গে আমার শেল্টারকে আরও বড় করতে চাই, যেখানে আমি যদি কখনো নাও থাকি যেন আমার মতো আরও একজন ওদের পাশে এসে দাঁড়ায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘মানুষের উদ্দেশে শুধু এটাই বলব আমরা যেমন সামান্য আাঘাতে কষ্ট পাই ঠিক তেমনি ওরাও পায়। আমরা বিনা কারণে ওদের আঘাত করি, এসব করা যাবে না। একটা কুকুর রাস্তায় আপনাকে বিনা কারণে কখনোই কামড় দেবে না। আমরা অনেকেই ইচ্ছে করে হোক বা ভুলবসত রাস্তায় ওদের ওপর দিয়ে গাড়ি তুলে দিই, সবার কাছে অনুরোধ একটা জীবন এভাবে শেষ করবেন না। আমরা মানুষ কথা বলতে পারি, প্রকাশ করতে পারি, ওরা পারে না। ১০ টাকা দামের রুটি রাস্তার একটা কুকুরকে কিনে দিলে সম্পদ কমে যাবে না; কিন্তু এই কুকুরটা আপনাকে সারা জীবন মনে রাখবে, এটাই হলো কৃতজ্ঞতা।’
সম্পাদক ও প্রকাশক : সালাহ্উদ্দিন শুভ ,মোবাইল : 01710668127 ইমেইল : protidinermoulvibazar@gmail.com
© ২০২৪ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | প্রতিদিনের মৌলভীবাজার | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।