হে রমজান!
তোমাকে স্বাগতম, প্রিয়মুখ ও দর্শনার্থী হিসেবে। দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর ভালোবাসা আমাদের তার দিকে ধাবিত করেছে। আগমনে প্রবল তামান্না আমাদের তার দিকে হাঁকিয়ে এনেছে।
হে রমজান,
এই তো নতুন চাঁদ তোমার পূর্বক্ষণে উঁকি দিয়েছে। সে অনুমতি প্রার্থনা করছে এবং ভেতরে প্রবেশের জন্য দরজায় কড়া নাড়ছে। সুতরাং তোমাকে সুস্বাগতম, তনোমনে আলিঙ্গন করে নিলাম তোমাকে।
হে রমজান,
তুমি ছিন্ন করে দাও কু-প্রবৃত্তির পর্দা। দিগন্তে দিগন্তে ছড়িয়ে দাও তোমার নূরের জ্যোতি। মূলোৎপাটন করো অনিষ্টের শিকড়। আমাদের মাঝে বপন করো ভালোবাসার বীজ। অন্তর-আত্মাকে করো কু-প্রবৃত্তির ব্যাধি থেকে মুক্ত।
হে রমজান,
আমাদের মুখাবয়ব শুষ্ক হয়ে গেছে, তুমি তা সিঞ্চিত করে দাও। পাপের ভারে আমাদের দেহগুলো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, তুমি তা হালকা করে দাও। আমাদের অন্তর-আত্মায় অভিলাষ ও প্রবৃত্তি আধিপত্য বিস্তার করেছে, তুমি বিতাড়ন করে দাও। আমাদের বিবেক ও উদ্দেশ্যগুলো নাপাক হয়ে গেছে, তুমি তা পবিত্র করে দাও। আমাদের জীবন পরাক্রমশালীর ক্রোধের সম্মুখীন হয়েছে সুতরাং তুমি মুক্তি দাও। ওই শোনো, বিপদগ্রস্তের চিৎকার ভেসে আসছে, দ্রুত ছুটে এসো।
এখনই আরোগ্য লাভের সময়
হে ভাই, তোমার অন্তর যদি এই রমাদান মাসে উজ্জীবিত না-হয় তাহলে আর কবে হবে। আরোগ্য লাভের মাসে যদি অন্তর সুস্থ না-হয় তাহলে আর কবে আরোগ্য লাভ করবে। সর্বনাশ ওই ব্যক্তির জন্য যে ক্ষমার জমিনে অবতরণ করেছে অথচ সেখান থেকে সামান্য অংশও উত্তোলন করতে পারেনি। ওই ব্যক্তির সর্বনাশ হোক, যে ব্যবসায় লাভের মৌসুম পেয়েও জান্নাতের প্রাসাদ ক্রয় করতে পারেনি।
ওই ব্যক্তির সর্বনাশ হোক, যে রহমতের বাজারে প্রবেশ করে ঘুমিয়ে পড়েছে অথচ জানা আছে, মাস শেষে বাজার বন্ধ হয়ে যায়। তার সর্বনাশ হোক, তার সর্বনাশ হোক।
হে ভাই! নিজের দুনিয়ার জন্য তুমি যেভাবে চিন্তা করো আখেরাতকে পাওয়ার জন্য ঠিক সেভাবে চিন্তা করো। তোমার পায়ে যদি কাটা বিদ্ধ হয়, তাহলে কি তুমি ব্যথায় নির্ঘুম কাটাও না? এবং ডাক্তারের অপেক্ষায় থাক না? এগুলো তো গোনাহ নামক কাঁটা, বছর ধরে তোমার হৃদয় কলুষিত করে রেখেছে; কিন্তু এ ক্ষেত্রে তোমার তো ব্যথার আওয়াজ শোনা যায় না! কোনো সাহায্যকারীকেও তালাশ করছ না। তোমার সর্বনাশ হোক, তুমি শরীরে রোগ হলে ব্যথা পাও অথচ অন্তরে রোগ হলে ব্যথা অনুভব করো না। রমজান হলো একজন অভিজ্ঞ ও হিতাকাঙ্ক্ষী ডাক্তার, সে তোমার নিকট ওষুধ বহন করে নিয়ে আসে, তুমি কীভাবে তাকে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দাও, অথচ সে তোমার শান্তি নিয়ে এসেছে। তুমি তার আগমনে কেন স্বাগতম জানাও না, অথচ তার সম্মুখে রয়েছে ফ্রি চিকিৎসার যাবতীয় উপকরণ।
রমজান, মুক্তির মাস
রমজান, মুক্তির মাস; মাছ শিকারির জালে আটকা পড়ে মরিয়া হয়ে ছিদ্র তালাশ করে, যাতে সে পালিয়ে যেতে পারে। অতঃপর যখন কোনো পথ খুঁজে না পায় তখন একটু পিছনের দিকে হটে তারপর দেহের সব শক্তি সঞ্চয় করে সম্মুখপানে দৌড় দেয় এবং বন্দিত্বের সংকীর্ণতা থেকে স্বাধীন প্রশস্ত জায়গার দিকে বেরিয়ে আসে। এখানে সে যদি এভাবে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ না-হতো তাহলে কিন্তু কিছুক্ষণ পর চুলার আগুন তাকে ঝলসে দিত। এখন আপনার আরও বেশি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে হবে। কেননা শয়তান আপনার চার পাশে তার জাল বিস্তার করে রেখেছে। এবং তার নোঙর শক্তিশালী করে ফেলেছে। তার নিল নকশার প্রতিফলন ঘটাচ্ছে। যার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো পরিশেষে আপনাকে চিরস্থায়ী জাহান্নামের অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করা। আপনি তার সঙ্গে একই কয়েদখানায় বসবাস করবেন। দুজনেই সমানভাবে জাহান্নামের আগুনে পুড়ে ভস্ম হবেন। তাহলে আপনি কি পদক্ষেপ নেবেন; সব কিছু আপনার বিপক্ষে, আপনার কলব আপনার বিপক্ষে, দুনিয়া আপনাকে মোহাবিষ্ট করে রেখেছে। স্বাধীন জীবনযাপন আপনাকে ধ্বংস করতে উদ্যত, কু-প্রবৃত্তি আপনাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তারপরও আপনি ঘাবড়ে যাবেন না কারণ আল্লাহই আপনার জন্য যথেষ্ট, তিনি সর্বদা সঙ্গে আছেন। তিনি এই মাসে প্রতিটি কাজের প্রতিদান দ্বিগুণ করে রেখেছেন। সন্তুষ্টির ধারা প্রবাহিত করে দিয়েছেন। শয়তানি চক্রকে শিকলাব্ধ করেছেন। এখন সুযোগ আপনার। আপনি রমাদানে একটা স্টেশন তৈরি করুন যা জান্নাতের পাথেয় হবে। আপনার সুযোগ তাতে অপ্রতিরুদ্ধ শক্তি সঞ্চয়ের এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞের পাথেয় গ্রহণের। আপনার সুযোগ তাতে জীবনের হিসাব-নিকাশের, মুরাজায়ার পাতা তৈরির, সংশোধনের ম্যাপ তৈরির এবং চলার গতি সঞ্চয়ের।
হে ভাই,
রমজান, মেহমান, পরিদর্শক আর আপনি মেজবান, কিন্তু আপনার আথিথেয়তার দায়িত্ববোধ কতটুকু?
রমজান, একটি সমুদ্র আর ঈদের দিন হলো তার তীর। সুতরাং তীরে আসার পূর্বে আপনার শিকার কি পরিমাণ হয়েছে? রমাদান মণিমুক্ত, যা কতগুলো দিনের ভিড়ে আপনার অপেক্ষারত। সুতরাং কোথায় সমুদ্র জয়ের বাহাদুর? কোথায় সাহসী ডুবুরি?
হে অশ্রু স্বল্পতায় শুষ্ক চক্ষুরা, এটা বৃষ্টির মৌসুম। হে পর্বতের প্রস্তর সদৃশ্য শক্ত হৃদয়ের অধিকারী, প্রচণ্ড ভীতি থেকে নেমে এসো। হে বিপথগামী আত্মা, হে অন্তসার শূন্য ব্যক্তিত্ব। হে ধ্বংসাত্মক মরুর পথহারা,
রমজান, নিবকটবর্তী আশা, বর্তমান আশা, শেষ আশা, অলসতার দরজা বন্ধ করে দাও এবং আমলের দরজা খুলে দাও। এসো, আমলের দিকে দৌড়ে এসো। এখনই এসো। পরিশেষে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন এই কিতাবটিকে বদ্ধ হৃদয়গুলোর চাবি হিসাবে গ্রহণ করেন, এমন এক মৌসুমে যাতে অন্তরগুলো উন্মুক্ত হয়ে যায়। এবং প্রার্থনা করি তিনি যেন এই বিজয়কে অন্য একটি বিজয়ের জন্য ইতিহাস রচনা করে দেন আর তা হলো বাইতুল মাকদিস বিজয়ের পথ সুগম হওয়া। আমরা তার তালা ভেঙে দিব এবং ইয়াহুদি সম্প্রদায়কে সেখান থেকে বিতাড়িত করব। উত্তম বিনিময়, বিজয়ের বিনিময়ে বিজয়, সাহায্যের বিনিময়ে সাহায্য। এখানে আমরা অন্তর সমূহের অভিলাষের বিপক্ষে রমাদানকে সাহায্য করব ফলে সেখানে আমাদের শত্রুর বিপক্ষে সাহায্য করা হবে। অন্যথায় আমরা কীভাবে একটা সাহায্যকে ধীরজ্ঞান করব যা আমরা হারিয়েছি? আর কীভাবে একজন জালেমের ব্যাপারে অভিযোগ করব যাকে আমরা ক্লান্ত করে রেখেছি? এবং কীভাবে প্রতিপালককে ডাকব যাকে আমরা পরিত্যাগ করেছি। হে আল্লাহ, আপনি এ বছরের রমাদানকে পূর্বের রমজানের চেয়ে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ করে দিন। এবং গফিলতির ঘুম থেকে আমাদের জাগিয়ে তুলুন। এবং মৃতদেহের আত্মাগুলোতে আপনার রুহু ফুৎকার দিয়ে সঞ্জীবিত করে দিন। হে আল্লাহ আপনি আমাদের ডাকে সাড়া দিন।
নবীর কথা মান্য করুন
আবু উমামা রাযি. সূত্রে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললাম ইয়া রাসুল্লাহ! আমাকে কোনো আমলের নির্দেশ দিন। তিনি আমাকে বললেন: তুমি রোজা রাখো, কেননা তার সমতুল্য কোনো আমল নেই।
আবু উমামা রাযি. ও তার পরিবার রোজা পালনে অভ্যস্ত ছিলেন। যে কারণে তার বাড়িতে দিনের বেলা আগুনের ধোঁয়া দেখা যেত না। তবে কখনো দেখা গেলেও সেটা ছিল কোনো হেমমানের আগমন উপলক্ষে। অবশ্য তার পরিবার ও পরিজন তখনো সওম পালনরত ছিলেন।
আবু উমামা মনে করেছেন, রোজা তো একটি সাধারণ স্বভাবসুলভ আমল মাত্র, তাই তিনি দ্বিতীয়বার আবার রাসুলের নিকট আবেদন করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমাকে কোনো আমলের নির্দেশ দিন, রাসুলুল্লাহ ঠিক আগের উত্তরটিই প্রদান করলেন। একথার মাধ্যমে রাসুল তার তালিম-তরবিয়ত ও রোজা রাখার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। এবং এদিকে ইঙ্গিত করেছেন, রোজা রাখার বিপুল কল্যাণ রয়েছে। আর এতে মুমিনের মর্যাদাও উন্নীত হয়।
সিজদায়ে শোকর
অতিমূল্যবান বিপুল পরিমাণ হাদিয়া-উপঢৌকন নিয়ে আমাদের মধ্যে উপস্থিত হতে যাচ্ছে, ‘মাহে রমাদান’। কাগজে-কলমে এসব উপঢৌকন সম্পর্কে আলোচনার উদ্দেশ্য হলো: ‘ যেন মাহে রমজান,’ প্রতিটি মুমিনের মেধায়-মননে প্রস্তরাঙ্কিত হয়ে যায়। অন্তরে স্পন্দন হয়। দেহের অঙ্গ-প্রতঙ্গে বাস্তব আমলের মাধ্যমে সচল থাকে। আর প্রকাশে-গোপনে শোকর আদায়ে সচেষ্ট হয়। এমনিতেই মাহে রমজান এলে প্রতিটি মুমিনের শোকর আদায় করা উচিত। শোকর আদায়ের একটি উত্তম পদ্ধতি হলো; ‘সিজদায়ে শোকর’।
ইমাম নববী রহ. ‘কিতাবুল আজকার’-এ উল্লেখ করেন:
জেনে রাখো, যে ব্যক্তির বাহ্যিক নতুন কোনো নেয়ামত লাভ করলে অথবা বাহ্যিক কোনো আপদ দূরীভূত হলে তার জন্য মুস্তাহাব হলো সিজদায়ে শোকর আদায় করা। অথবা আল্লাহতায়ালার যথাযোগ্য প্রশংসা আদায় করা। সুতরাং আপনি রমজান মাসে উপনীত হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করুন আর রব্বে কারিমের সিজদায় লুটিয়ে পড়ুন।
লেখক: ইসলামী চিন্তাবিদ
সম্পাদক ও প্রকাশক : সালাহ্উদ্দিন শুভ ,মোবাইল : 01710668127 ইমেইল : protidinermoulvibazar@gmail.com
© ২০২৪ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | প্রতিদিনের মৌলভীবাজার | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।