বছর ঘুরে পুনরায় সমাগত আত্মশুদ্ধি, সাম্য, সহমর্মিতা ও মানবীয় গুণাবলি, পাপ ছেড়ে পুণ্য জোগাড়ের মাস পবিত্র রমজান। মুসলিম জাতীয় ঐতিহ্য চেতনায় এবং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনে রমজান অতি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা রমজান মাস পবিত্র কুরআন নাজিলের মাস, ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও বিজয়ের মাস। মুসলমানদের দ্বীন ও দুনিয়ার সমৃদ্ধি, পার্থিব ও আধ্যাত্মিক উন্নতি, দৈহিক ও মানবিক শ্রেষ্ঠত্ব, গৌরব ও মর্যাদার অবিস্মরণীয় প্রভাব বয়ে আনে মাহে রমজান। উন্নত চরিত্র অর্জনের পক্ষে অন্তরায় পাশবিক বাসনার প্রাবল্যকে পরাভূত করে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির সামনে নিজেকে সমর্পণ করা হচ্ছে সিয়ামের তাৎপর্য। ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে সর্বত্র আল্লাহর দ্বীনের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় যাবতীয় প্রতিকূলতার মুখে টিকে থাকার জন্য যে মন-মানসিকতার প্রয়োজন সিয়াম সাধনার দ্বারাই তা অর্জিত হয়। রমজানে সংযম ও আত্মত্যাগের অনুশীলন এবং সেইসঙ্গে ইসলামভিত্তিক ন্যায়, সত্য ও সততা প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ প্রয়োজন। এসব ত্যাগ-তিতীক্ষা ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় প্রমাণিত, শাশ্বত ও জীবন্ত। তাই মহান আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস রেখে অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার অনুশীলন করার সুযোগ আসে রমজান মাসে। নৈতিকতা, শালীনতা ও ইফতার গ্রহণের মাধ্যমে সহমর্মিতার অভ্যাস গড়ে তুলে ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক কল্যাণ সাধনের পথ প্রশস্ত করার অনুশীলন করার মাস রমজান। চিরায়ত ইসলামি মূল্যবোধ, ধ্যান-ধারণা, চরিত্র, ধর্ম ও আদর্শ রক্ষায় ইসলামি নিয়মকানুন অনুশীলনের চেতনা জোরদার করতে হবে। তা ছাড়া সিয়াম সাধনার মধ্য দিয়ে মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে মাগফেরাত কামনা করতে হবে।
রমজান যেভাবে নেয়ামত : মুসলমানদের জন্য আল্লাহ তায়ালার এক বিশাল নেয়ামত হচ্ছে রমজান মাস। আমরা কি রমজানের হাকিকত ও এর মর্তবা-মর্যাদা সম্পর্কে অবগত হওয়ার গরজ বোধ করি? দুঃখজনক হচ্ছে, অনেক মানুষ দিবানিশি দুনিয়ার ঝামেলার মধ্যে ডুবে থাকে। সকাল-সন্ধ্যা নিজের ধান্ধা-ফিকিরের চক্করেই সময় বিনষ্ট হয়ে যায়। পার্থিব স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া যেন অধিকাংশের অস্থিমজ্জায় মিশে গেছে। অন্তত রমজানের আগমুহূর্তে কিছু সময় চিন্তা করা দরকার, মহান আল্লাহ আমাকে কোন উদ্দেশ্যে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন আর আমি কী করছি। প্রতি বছর রমজান আসে-যায়, আমার জীবনে কি পরিবর্তন আসে? রমজানের মাহাত্ম্য, এর গুরুত্ব, ফজিলত ও মর্তবা একমাত্র তাদের কাছেই থাকে, যারা এ মাসের বরকত সম্পর্কে অবগত। যারা জানে এ মাসটি আল্লাহর নুরে ও জ্যোতিতে পরিপূর্ণ। এ মাসে আল্লাহর রহমতের প্লাবন বয়ে যায়, এ ধারণা যাদের আছে তারাই এ মাসের সম্মান করে থাকে। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) এক হাদিসে ইরশাদ করেন, ‘হে আল্লাহ! রজব ও শাবান মাসে আমাদের ওপর বরকত অবতীর্ণ করুন। আর আমাদের রমজানে পৌঁছিয়ে দিন’ (মাজমাউয যাওয়ায়িদ : ২/১৬৫)। এই হাদিসের মর্ম হলো, আমাদের বয়স এতটুকু দীর্ঘ করে দেওয়া হোক, যেন রমজান মাসের সৌভাগ্য আমাদের অর্জিত হয়। এ থেকেই অনুমান করা যায় যে, দুমাস পূর্ব থেকেই রমজানের জন্য অধীর অপেক্ষার পর্বটি শুরু হয়ে যায়। আর এই অপেক্ষার পর্বটি একমাত্র তাদের দ্বারাই হতে পারে, যারা এ মাসের মর্যাদা, এ মাসের গুরুত্ব ও ফজিলত উপলব্ধি করতে সক্ষম।
রহমতের বিশেষ মাস : মহান আল্লাহ মানবজাতির সৃষ্টিকর্তা। তাই তিনি জ্ঞাত ছিলেন মানুষ দুনিয়ার ধান্ধায় জড়িয়ে তাকে ভুলে যাবে। দুনিয়ার কর্মকাণ্ডে সে যত নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়বে, আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার একাগ্রতায় ততই দুর্বলতা আসবে। এ কারণেই আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে একটি সুবর্ণ সুযোগ করে দেন। তিনি তাদের উদ্দেশে ঘোষণা দিয়েছেন, প্রতি বছর আমি তোমাদের একটি মাস প্রদান করছি। এগারো মাস দুনিয়াদারি ও অর্থকড়ির পেছনে ছোটাছুটি করার কারণে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে। আন্তরিকতার সঙ্গে এই একটি মাস যদি তোমরা আমার কাছে প্রত্যাবর্তন করো, তা হলে এগারো মাসে যে আধ্যাত্মিক ঘাটতি তোমাদের হয়েছে, আমার নৈকট্য অর্জনের ক্ষেত্রে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে, এই মহান ও পবিত্র মাসে তোমরা তা পূরণ করে নাও। নিজের অন্তরের জং দূর করে পবিত্র হয়ে যাও। আমার সঙ্গে দূরত্ব হ্রাস করে নৈকট্য অর্জন করে নাও। অন্তরে আমার স্মরণ ও জিকির বাড়িয়ে দাও। মহান রাব্বুল আলামিন এই উদ্দেশ্যেই মুসলিম উম্মাহর জন্য বরকতময় রমজান দান করেছেন। এই উদ্দেশ্য অর্জনে, আল্লাহর নৈকট্য হাসিল ও সান্নিধ্য অর্জনে রোজার প্রথম ও প্রধান ভূমিকা রয়েছে। রোজা ছাড়া আর যেসব ইবাদত এই পবিত্র মাসে মুসলমানদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে সেগুলোও আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য ও সান্নিধ্য অর্জনে বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্য একটিই, আর তা হলো, এই পুণ্যময় মাসের মাধ্যমে মানবজাতিকে নিজের কাছে টেনে নেওয়া।
আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম : মহান রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জনে সক্ষম হও। অর্থাৎ পরহেজগারি অর্জন করতে পারো’ (সুরা বাকারা : ১৮৩)। এগারো মাস তোমরা যেসব কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে ছিলে সেইসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তোমাদের তাকওয়ার বৈশিষ্ট্যে দুর্বলতা এসে গিয়েছিল। এবার রোজার মাধ্যমে তাকওয়ার সেই বৈশিষ্ট্যকে সবল করে নাও। কথা এখানেই শেষ নয় বা এতটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় যে, রোজা রাখা হলো আর তারাবির নামাজ পড়া হলো, এতেই সবকিছু চুকে গেল। বরং পুরো রমজানটাকে এমনভাবে কাটানো যে, এগারো মাস আমরা জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য থেকে সরে ছিলাম, ইবাদত-বন্দেগি থেকে সম্পর্কহীন ছিলাম। এই দূরত্ব ও সম্পর্কহীনতাকে কাটাতে হবে। আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে হবে। তাঁর সান্নিধ্য লাভের প্রচেষ্টায় পুরো এই মাসটি কাটিয়ে দিতে হবে। এর পদ্ধতি এমন হতে পারে যে, পূর্ব থেকেই রমজান মাসটিকে দুনিয়াবি কর্মকাণ্ড থেকে মুক্ত করে নিতে হবে। কেননা এগারো মাস তো দুনিয়ার কাজেই বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে। তাই এই মাসে দুনিয়ার কর্মকাণ্ড যতটুকু সংক্ষিপ্ত করা যায় তা করতে কার্পণ্য করা উচিত না। এ মাসটি হবে একজন মুসলমানের জন্য খালেস ইবাদতের মাস। আল্লাহর নৈকট্য ও সান্নিধ্য অর্জনের মাস। শুধু উপবাস থাকাই রমজানের সাফল্যের শর্ত নয় বরং উপবাসের সঙ্গে যাবতীয় পাপ কাজ যেমন, মিথ্যা কথা বলা, গিবত করা, চোগলখোরি, মুনাফাখোরি, কালোবাজারি, প্রতারণা ও প্রবঞ্চনার মতো ইসলামবিরোধী কাজ থেকে বিরত থাকার কঠোর অনুশীলন না করলে রমজানের সুফল পাওয়া যাবে না। আল্লাহ তায়ালা বিশ্ব মুসলিমকে পবিত্র রমজানের পবিত্রতা বজায় রেখে এর মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব উপলব্ধি করার ও জীবনে তা বাস্তবায়ন করার তওফিক দান করুন।
সম্পাদক ও প্রকাশক : সালাহ্উদ্দিন শুভ ,মোবাইল : 01710668127 ইমেইল : protidinermoulvibazar@gmail.com
© ২০২৪ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | প্রতিদিনের মৌলভীবাজার | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।