আবারও আলোচনায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস। হঠাৎ করেই গত ১৫ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে তিনি অভিযোগ করেন, তার সাতটি প্রতিষ্ঠান নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে গ্রামীণ ব্যাংক। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলো ‘জবরদখল’ করা হয়েছে। তার এ বক্তব্যে শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা। গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষ থেকেও দেওয়া হয়েছে জবাব। যেখানে প্রতিষ্ঠানটির দাবি, সবগুলো প্রতিষ্ঠানই তাদের ব্যাংকের অর্থে গড়া হয়েছে। আইনগতভাবেই চেয়ারম্যান ও পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এখানে ‘জবরদখল’-এর কিছু নেই।
প্রশ্ন উঠেছে, গ্রামীণ ব্যাংকের অর্থে গড়া প্রতিষ্ঠানের মালিক কীভাবে হন পেশায় শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দেওয়া ড. মুহাম্মদ ইউনূস? এ ছাড়া অনেকেই বলছেন, গ্রামীণ টেলিকমও অলাভজনক হিসেবে পরিচালিত হওয়ার কথা। সেখানে কীভাবে এর লভ্যাংশের কথা বলছেন তিনি? এ ছাড়াও গ্রামীণ নামে প্রতিষ্ঠিত যে সাত প্রতিষ্ঠানে নিজের মালিকানা দাবি করেছেন ইউনূস, সেগুলোর মূলধন কোথা থেকে এসেছে তা নিয়েও শুরু হয়েছে জল্পনা। জানা যায়, গ্রামীণ টেলিকম ভবনে ড. ইউনূসের ১৬টি কোম্পানি রয়েছে। যার প্রতিটির চেয়ারম্যান ড. ইউনূস।
অন্যদিকে দেশের আদালত নিয়েও নানা প্রশ্ন তুলেছেন ড. ইউনূস। তার বক্তব্য, আদালতের প্রতি বিশ্বাস নেই তার। যদিও জবরদখলের অভিযোগ করে এই ঘটনায় মামলা করার কথা জানিয়েছেন তিনি। এই একই সময়ে তার কন্যা ইসরায়েলের সমর্থনে থাকা মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে সাক্ষাৎকার দিয়ে নানা অভিযোগ তুলে ধরেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই ড. ইউনূসের এসব কাণ্ডকে দেখছেন রাজনীতিকরণের প্রচেষ্টা হিসেবে।
ড. ইউনূসের অভিযোগ
গত বৃহস্পতিবার ঢাকার মিরপুরে গ্রামীণ টেলিকম ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে ড. ইউনূস দাবি করেন, গ্রামীণ ব্যাংক তাদের আটটি প্রতিষ্ঠান জবরদখল করে তাদের মতো করে চালাচ্ছে। পুলিশের কাছে এ বিষয়ে প্রতিকার চাইলেও সহযোগিতা পাওয়া যায়নি।
ঢাকার মিরপুর ১ নম্বরে চিড়িয়াখানা সড়কে গ্রামীণ টেলিকম ভবন। এই ভবনে ১৬টি কোম্পানির কার্যালয়, যার প্রতিটির চেয়ারম্যান ড. ইউনূস।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এ ভবনের আটটি অফিস দখল করে নেওয়া হয় বলে দাবি করে তিনি বলেন, ‘ওই দিন থেকে তারা ভবনে তালা মেরে রেখেছে। নিজের বাড়িতে অন্য কেউ যদি তালা মারে, তখন কেমন লাগার কথা আপনারাই বলেন। তাহলে দেশে আইন-আদালত আছে কীসের জন্য। তারা আদালতে যেতে চায় না। আমরা জীবনে বহু দুর্যোগ দেখেছি। এমন দুর্যোগ আর কখনও দেখিনি।’
গ্রামীণ ব্যাংকের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার কথাও বলেন সরকারি প্রজ্ঞাপনে প্রতিষ্ঠিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
গ্রামীণ ব্যাংকের টাকায় এসব প্রতিষ্ঠান
ইউনূসের অভিযোগ খারিজ করে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান সাইফুল মজিদ বলেন, ‘আইনি বৈধতার ভিত্তিতে রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক (আরজেএসসি) হতে এসব প্রতিষ্ঠানের আর্টিকেল অব মেমোরেন্ডামের সার্টিফাইড কপি তোলা হয়েছে। এর কোনো পরিবর্তন হয়নি। সেখানে লেখা বিধি মোতাবেক পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আইনের বাইরে কিছুই হয়নি।’
গ্রামীণ ব্যাংকের সব টাকা এর বিত্তহীন, দরিদ্র, ভূমিহীন ও অসহায়ের কাজে ব্যয় করার বিধান রয়েছে জানিয়ে কত টাকা, কোথায় গেছে তার হিসাবও চান তিনি। বলেন, ‘গ্রামীণ ব্যাংকের মধ্য থেকে অনেক কিছু করা সম্ভব ছিল। এত প্রতিষ্ঠান বাড়ানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না।’
বিদেশি অনুদান নিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ‘এনডাউমেন্ট ফান্ড’ নামে গ্রামীণ কল্যাণকে টাকা দেওয়া হয় জানিয়ে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান বলেন, ‘৪৪ কোটি টাকা গ্রামীণ ব্যাংক থেকে হস্তান্তর করা হয়। অনুদানসহ সব মিলিয়ে ৪৪৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকা দেওয়া হয় গ্রামীণ কল্যাণে। এসবই গ্রামীণ ব্যাংকের টাকা।’
গ্রামীণ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ড. মুহাম্মদ ইউনূস অবৈধভাবে জালিয়াতের মাধ্যমে ২৮টি গ্রামীণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। গ্রামীণ ব্যাংকের অর্থে প্রতিষ্ঠিত হলেও বেআইনিভাবে এগুলোর মালিকানা নিজের নামে করে নেন
সম্প্রতি বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এসব প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের অধীনে নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে প্রকৃত মালিক গ্রামীণ ব্যাংক। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে ১৩ ফেব্রুয়ারি গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব গ্রহণ শুরু করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ ইউনূসের বিরুদ্ধে
প্রতিষ্ঠার সাল ১৯৮৩ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত নিরীক্ষার দাবি করে গ্রামীণ ব্যাংক চেয়ারম্যান বলেন, ‘১৯৯০ সালের আগে কোনো লেজার পাওয়া যায়নি।’
মুহাম্মদ ইউনূস মানি লন্ডারিং করেছেন অভিযোগ এনে তিনি বলেন, ‘সেই প্রমাণ রয়েছে। গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ কল্যাণ, গ্রামীণ ফান্ড- এসব প্রতিষ্ঠান গড়তে গিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা সরিয়েছেন অধ্যাপক ইউনূস।’
গ্রামীণ ব্যাংকের আইন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মাসুদ আক্তার বলেন, ‘গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক দরিদ্র ও ভূমিহীন মানুষ। সেই ব্যাংকের টাকায় যে প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি, তার মালিক সদস্যরা।’
অর্থ জালিয়াতির অভিযোগ
১৯৮৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সরকার গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ (অধ্যাদেশ নম্বর-৪৬) জারি করে। শুরুতে গ্রামীণ ব্যাংকের মূলধন ছিল মাত্র তিন কোটি টাকা। এর মধ্যে বেশিরভাগই অর্থাৎ ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ছিল সরকারের। বাকি ১ কোটি ২০ লাখ টাকা ছিল ঋণ গ্রহীতাদের। অর্থাৎ গ্রামীণ ব্যাংকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যক্তিগত কোনো টাকা ছিল না। অথচ এই ব্যাংকটির টাকায় ড. ইউনূস গড়ে তুলেছেন নিয়ন্ত্রণাধীন ২৮টি প্রতিষ্ঠান।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, গ্রামীণ ব্যাংক তথা সরকারের টাকা আত্মসাৎ করে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়ার।
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই গ্রামীণ ব্যাংকে ঋণ এবং অনুদান দেয় দাতা গোষ্ঠী। অনুদানের সব অর্থ যদি রাষ্ট্র এবং জনগণের কাছে যায় তাহলে কারও ব্যক্তিগত লাভের সুযোগ থাকে না। তাই দাতাদের অনুদানের অর্থ দিয়ে সোশাল ভেনচার ক্যাপিটাল ফান্ড (এসভিসিএফ) গঠন করেন ড. ইউনূস।
১৯৯২ সালের ৭ অক্টোবর ওই ফান্ড দিয়ে আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯৯৪ সালে ‘গ্রামীণ ফান্ড’ নামের একটি লিমিটেড কোম্পানি গঠন করা হয়। তাতে ওই ফান্ডের ৪৯ দশমিক ১০ কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয়।
গ্রামীণ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, শুরু থেকেই গ্রামীণ ব্যাংক দেখিয়ে বিদেশ থেকে টাকা এনে তা সরিয়ে ফেলার চেষ্টা ছিল। গ্রামীণ ব্যাংক সরকারি প্রতিষ্ঠান হলেও এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে একাই সব সিদ্ধান্ত নিতেন ড. ইউনূস। পরিচালনা পর্ষদ এমনভাবে গঠন করা হয়েছিল, যাতে কেউ ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে কথা বলতে না পারেন। আর এই সুযোগেই ১৯৯৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর গ্রামীণ ব্যাংকের ৩৪তম বোর্ড সভায় সিদ্ধান্ত হয়, দাতা গোষ্ঠীর অনুদানের অর্থ এবং ঋণ দিয়ে সোশাল এডভান্সমেন্ট ফান্ড (এসএএফ) গঠন করা হবে। কিন্তু দাতারা গ্রামীণ ব্যাংক থেকে এভাবে অর্থ সরিয়ে ফেলার বিষয়ে আপত্তি জানায়। তাদের মত ছিল, এভাবে অর্থ স্থানান্তর জালিয়াতি।
এরপর ভিন্ন কৌশল নিয়ে ১৯৯৬ সালের ২৫ এপ্রিল গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ড সভায় ‘গ্রামীণ কল্যাণ’ গঠনের প্রস্তাব আনেন ড. ইউনূস।
প্রস্তাবে বলা হয়, গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য ও কর্মীদের কল্যাণে ‘কোম্পানি আইন ১৯৯৪’-এর আওতায় গ্রামীণ কল্যাণ নামের একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা। গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ড সভা এই প্রস্তাব অনুমোদন করে। এটি গ্রামীণ ব্যাংকেরই অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। গ্রামীণ কল্যাণ যে গ্রামীণ ব্যাংকেরই শাখা প্রতিষ্ঠান, তা আরও স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় এর মূলধন গঠন প্রক্রিয়ায়।
গ্রামীণ কল্যাণ-এ গ্রামীণ ব্যাংকের সোশাল এডভান্সমেন্ট ফান্ড (এসএএফ) থেকে ৬৯ কোটি টাকা প্রদান করা হয়। গ্রামীণ কল্যাণের মেমোরেন্ডাম অব আর্টিকেলেও গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে এর সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মেলে।
মেমোরেন্ডাম অব আর্টিকেল অনুযায়ী, গ্রামীণ কল্যাণের ৯ সদস্যের পরিচালনা পরিষদের ২ জন সদস্য গ্রামীণ ব্যাংকের মনোনীত প্রতিনিধি। এ ছাড়াও গ্রামীণ কল্যাণের চেয়ারম্যান হবেন গ্রামীণ ব্যাংকের মনোনীত প্রতিনিধি। ড. ইউনূসও গ্রামীণ ব্যাংকের মনোনীত প্রতিনিধি হিসেবেই গ্রামীণ কল্যাণের চেয়ারম্যান হন।
এরপর গ্রামীণ কল্যাণের মাধ্যমে তিনি গড়ে তোলেন একের পর এক প্রতিষ্ঠান। এগুলো হলো- ১. গ্রামীণ টেলিকম লি: ২. গ্রামীণ ডিস্ট্রিবিউশন লি: ৩. গ্রামীণ শিক্ষা ৪. গ্রামীণ নিটওয়্যার লি: ৫. গ্রামীণ ব্যবস্থা বিকাশ ৬. গ্রামীণ আইটি পার্ক ৭. গ্রামীণ ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট ৮. গ্রামীণ সলিউশন লি: ৯. গ্রামীণ ডানোন ফুডস: লি: ১০. গ্রামীণ হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস লি: ১১. গ্রামীণ স্টার এডুকেশন লি: ১২. গ্রামীণ ফেব্রিক্স অ্যান্ড ফ্যাশন লি: ১৩. গ্রামীণ কৃষি ফাউন্ডেশন।
অন্যদিকে, গ্রামীণ কল্যাণের আদলে প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ফান্ডের মাধ্যমে গঠন করা হয় আরও কিছু প্রতিষ্ঠান। এগুলো হলো-
১. গ্রামীণ ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লি:, ২. গ্রামীণ সল্যুশন লি:, ৩. গ্রামীণ উদ্যোগ, ৪. গ্রামীণ আইটেক লি:, ৫. গ্রামীণ সাইবারনেট লি:, ৬. গ্রামীণ নিটওয়্যার লি:, ৭. গ্রামীণ আইটি পার্ক, ৮. টিউলিপ ডেইরী অ্যান্ড প্রোডাক্ট লি:, ৯. গ্লোব কিডস ডিজিটাল লি:, ১০. গ্রামীণ বাইটেক লি:, ১১. গ্রামীণ সাইবার নেট লি:, ১২. গ্রামীণ স্টার এডুকেশন লি:, ১২. রফিক আটোভ্যান মানুফ্যাকটার লি:, ১৩. গ্রামীণ ইনফরমেশন হাইওয়ে লি:, ১৪. গ্রামীণ ব্যবস্থা সেবা লি:, ১৫. গ্রামীণ সামগ্রী।
গ্রামীণ ব্যাংকের অর্থে এবং বোর্ড সভার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে গ্রামীণ কল্যাণ এবং গ্রামীণ ফান্ড গঠিত হয়। এই দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যে প্রতিষ্ঠানগুলো গঠিত হয়েছে সেগুলোও আইনত গ্রামীণ ব্যাংকের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। ২০২০ সাল পর্যন্ত গ্রামীণ ফান্ড এবং গ্রামীণ কল্যাণের পরিচালনা পর্ষদে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিনিধিও ছিল। কিন্তু ২০২১ সাল থেকে এই প্রতিষ্ঠান দুটিতে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিনিধি নেই।
গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এই দুটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হবেন গ্রামীণ ব্যাংকের মনোনীত ব্যক্তি। কিন্তু ড. মুহাম্মদ ইউনূস এখনও গ্রামীণ কল্যাণ এবং গ্রামীণ ফান্ডের চেয়ারম্যান পদে বহাল আছেন। ফলে প্রশ্ন উঠছে, কোন কর্তৃত্ব বলে তিনি এখনও চেয়ারম্যান?
ব্যাংকটির একাধিক সূত্র দাবি করেছে, ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব থেকে অবসরে গেলেও ব্যাংকটি নিয়ন্ত্রণ করছে তার অনুগতরাই। ফলে এই অনিয়ম নিয়ে এতদিন কেউ মুখ খোলেননি।
গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের রহস্যময় আচরণের কারণেই এই ব্যাংকের অর্থে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানা বঞ্চিত হয় রাষ্ট্র ও জনগণ। তবে শেষ পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংকের ঘুম ভেঙেছে এবং গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্ধারের উদ্যোগ নিয়েছে।
ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে হিসাবে গরমিল
তথ্য বলছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে তিনটি। এই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তিনটি হলো যথাক্রমে:- ১. সাউথ ইস্ট ব্যাংক, (অ্যাকাউন্ট নম্বর-০২১২১০০০২০০৬১), ২. স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, (অ্যাকাউন্ট নম্বর- ১৮১২১২৭৪৭০১) এবং ৩. রূপালি ব্যাংক, (অ্যাকাউন্ট নম্বর-০৪৮৯০১০০০৮০৯৬)। এই তিনটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মধ্যে ২০০০ সালে খোলা সাউথ ইস্ট ব্যাংকের অ্যাকাউন্টটি (অ্যাকাউন্ট নাম্বার-০২১২১০০০২০০৬১) তার মূল ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হিসেবেই প্রতীয়মান হয়েছে। এই অ্যাকাউন্টে ২০০০ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১১৮ কোটি ২৭ লাখ ৭৬ হাজার ৩৬৮ টাকা রেমিট্যান্স এসেছে। এই রেমিট্যান্সের বেশিরভাগ ৪৭ কোটি ৮৯ লাখ ৯৬ হাজার ৬৫২ টাকা এসেছে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে। সেই সময়েই একটি রাজনৈতিক দল গঠনেরও প্রয়াস করেছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
অভিযোগ রয়েছে, ২০০৫-০৬ কর বছর থেকে শুরু করে ২০২২-২৩ কর বছর পর্যন্ত সরকারকে কর ফাঁকি দেওয়ার লক্ষ্যে তিনি ১৮ কোটি ৯৪ লাখ ৩৪ হাজার ৮৩৫ টাকা রেমিট্যান্সের তথ্য গোপন করেছেন।
২০২০-২১ অর্থবছরে ড. ইউনূস-এর ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায় সব টাকা তুলে ‘ইউনূস ট্রাস্ট’ গঠন করেন। ট্রাস্টের টাকা আয়করমুক্ত। সে হিসাব থেকেই এমন কাণ্ড করেন তিনি। কিন্তু এরকম ফান্ডের জন্য ১৫% কর দিতে হয়, এটি তিনি দেননি। এই ট্যাক্স ফাঁকির কারণেই তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। এই মামলায় তিনি হেরে যান। এখন মামলাটি আপিল বিভাগে বিচারাধীন।
আদালতে অনাস্থা ইউনূসের
গ্রামীণ টেলিকমে শ্রম আইন লঙ্ঘনের আলোচিত মামলাটির রায় ঘোষণা হয় গত ১ জানুয়ারি। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসসহ চারজন আসামিকে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে একটি ধারায় ছয় মাসের কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা করে জরিমানা করে সাজা দেয় আদালত।
আরেক ধারায় ২৫ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে ১৫ দিনের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী করা, ছুটি সংক্রান্ত সব বিষয় আগামী ৩০ দিনের মধ্যে সমাধান করতে নির্দেশ দিয়েছেন শ্রম আদালত।
সাজা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই আসামিদের আইনজীবী জামিন আবেদন করলে তা মঞ্জুর করেন আদালত। ফলে কারাগারে যেতে হয়নি ড. ইউনূসকে।
আদালত থেকে বেরিয়ে ইউনূস বলেন, যে দোষ আমরা করি নাই, সেই দোষের ওপরে শাস্তি পেলাম। এটা আমাদের কপালে ছিল, জাতির কপালে ছিল, আমরা সেটা বহন করলাম। তার আইনজীবী বলেন, এটা কোনো রায়ই হলো না। এটা নজিরবিহীন ঘটনা। যে অভিযোগে সিভিল মামলা হওয়ার কথা ছিলে। তাতে ফৌজদারি অপরাধে সাজা দেওয়া হলো। এর বিরুদ্ধে আপিল করব।
আদালতের রায় নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করলেও সম্প্রতি প্রতিষ্ঠান জবরদখলের অভিযোগ তোলার পর সেটি নিয়ে আদালতে যাওয়ার ঘোষণা দেন ইউনূস।
ইসরায়েলের পক্ষে থাকা সিএনএন চ্যানেলে ইউনূসকন্যার সাক্ষাৎকার
ফিলিস্তিনে গণহত্যা চালানো ইসরায়েলের হয়ে পক্ষপাতমূলক সংবাদ নীতির কারণে তোপের মুখে থাকা প্রতিষ্ঠানে সিএনএন চ্যানেলে সম্প্রতি সাক্ষাৎকার দেন ইউনূসের কন্যা ও মার্কিন নাগরিক মনিকা ইউনূস।
যেখানে তিনি বাংলাদেশের বিচার বিভাগের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি তিনি নিজের বাবার পক্ষে কথা বলতে গিয়ে দেশের সাংবিধানিক কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, শ্রম আইন লঙ্ঘনের দায়ে দণ্ড পাওয়া শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে শাস্তি থেকে রক্ষা করতে লবিংয়ে নেমেছেন তার কন্যা মনিকা ইউনূস।
এ ছাড়াও ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে চলা আইনি প্রক্রিয়া বন্ধ করতে নানাভাবে চলছে আন্তর্জাতিক লবিং। তাকে ‘আইনি হয়রানি’ বন্ধ করার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহ্বান জানিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টে বিজ্ঞাপন হিসেবে একটি যৌথ বিবৃতি ছাপা হয়েছে, যে বিবৃতি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ১২ জন সিনেটর।
এর আগে বিচার বন্ধে বিজ্ঞাপন আকারে বিবৃতি দিয়েছেন কয়েকজন নোবেলজয়ী। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে ইউনূসের পরিচিতি আছে।
এদিকে সাক্ষাৎকারে একাধিকবার ড. ইউনূস কেন বাংলাদেশ সরকারের প্রতিহিংসার শিকার তা জানতে চাইলেও এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি
রাজনীতিতে নজর ইউনূসের
২০০৭ সালে সেনা-নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের তখন গ্রেপ্তার করে কারাগারে আটকে রাখা হয়।
আর সেই রাজনীতি নিষিদ্ধ ও রাজনীতিবিদদের জেল-জুলমের সময়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নতুন একটি রাজনৈতিক দল খুলতে মাঠে নামেন। জরুরি অবস্থার মধ্যেই তিনি নাগরিক শক্তি নামের রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য ব্যাপক তোড়জোড় চালিয়েছিলেন, যা নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হয়।
রাজনীতিতে ইউনূসের আগ্রহের বিষয়ে মনিকা বলেন, শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তিনি একবারের জন্য এটা ভেবেছিলেন। তবে তার রাজনৈতিক কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই।
তবে উইকিলিকস থেকে ফাঁস হওয়া গোপন নথিতে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের প্রধান দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে নির্বাসনে পাঠাতে চেয়েছিলেন এই নোবেলজয়ী। জেনারেল মইন ইউ আহমেদের লেখা বই এবং আরও কিছু নথি থেকে এটি স্পষ্ট ছিল যে, ১-২ বছরের জন্য নয়, বরং দীর্ঘ মেয়াদে অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক সরকার গঠনের ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন ড. ইউনূস।
সম্পাদক ও প্রকাশক : সালাহ্উদ্দিন শুভ ,মোবাইল : 01710668127 ইমেইল : protidinermoulvibazar@gmail.com
© ২০২৪ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | প্রতিদিনের মৌলভীবাজার | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।